এই মুহূর্তে গ্যালারিতে বসে, টিভির সামনে কিংবা দেশে-বিদেশের যে যেখান থেকে যে অবস্থায় অনুষ্ঠানটি দেখছেন, সবাইকে জানাই সাদরে সম্ভাষণ’
ইত্যাদি নামের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবনে পরিবারের সবার মিলে একত্রে টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করার মতো স্মৃতি । ইত্যাদি বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। ইত্যাদি প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৮৯ সালে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিন মাস পর পর প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি। ইত্যাদির উপস্থাপক হলেন হানিফ সংকেত। দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এবং দীর্ঘ ৩৬ বছর ইত্যাদি চলছে সমানতালে। কারণ এর গ্রন্থনা, পরিকল্পনা এবং পরিচালনা যাঁর হাত ধরে, তিনি একজনই হানিফ সংকেত।
প্রকৌশল শাস্ত্রে লেখাপড়া শেষ করে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন হানিফ সংকেত। পরে ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী হিসেবে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। সংস্কৃতি চর্চার সূত্র ধরে পরিচয় হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রখ্যাত উপস্থাপক ও সাংবাদিক ফজলে লোহানীর সঙ্গে। লোহানীর হাত ধরেই হানিফ সংকেতকে পায় বিনোদন জগত। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৫ সাল প্রচারিত ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেন হানিফ সংকেত। ফজলে লোহানীর জীবদ্দশায় কর্তৃপক্ষ তাকে একক অনুষ্ঠান করতে অনুরোধ করলেও সায় দেননি হানিফ সংকেত।
১৯৮৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে মারা যান ফজলে লোহানী। এরপর বন্ধ হয়ে যায় ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানটি। এরপর হানিফ সংকেত ‘ঝলক’ ও ‘কথার কথা’ নামে দুটি অনুষ্ঠান করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে হানিফ সংকেতের রচনা, উপস্থাপনা ও পরিচালনায় নির্মাণ হয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারের শুরু থেকে সমাজের নানা দিক, অসংগতি তুলে ধরার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায় ইত্যাদি। তাঁর সামাজিক কার্যক্রমের জন্য তিনি ২০১০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এবং ২০১৪ সালে তিনি জাতীয় পরিবেশ পদক লাভ করেন।
বিবিসির জরিপ বলছে, বিশ্বের ৭৫ শতাংশ বাঙালি ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠান দেখেন। এই অনুষ্ঠানের পরিচালক এবং উপস্থাপককে সবাই শ্রদ্ধা করেন এবং ভালোবাসেন।
এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হানিফ সংকেত দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে বহু শিল্পীকে খ্যাতি এনে দিয়েছেন। এই তালিকায় আছেন, অভিনেতা আব্দুল কাদের, আফজাল শরীফ, অমল বোস, শিল্পী আকবর প্রমুখ। এছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রের অমর নায়ক সালমান শাহ সর্বপ্রথম ইত্যাদিতেই মডেল হিসেবে কাজ করেছিলেন।
হানিফ সংকেতের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও অভিনব প্রতিভা’
ইত্যাদির শুরুটা ৯০ এর দশকে, ইত্যাদির নতুন পর্ব আসে প্রতি তিন মাস পর পর, রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর এবং প্রতি মাসের প্রথম রোববার রাত ১০টার পর একটি সংকলিত পর্ব বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। এছাড়া প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের পরদিন রাত ১০টার সংবাদের পর ইত্যাদি প্রচারিত হয়।
ইত্যাদিতেই প্রথম শুরু হয় বিদেশি প্রতিবেদন শিরোনামে বিশ্বের বিস্ময়কর বিষয় ও স্থানের ওপর প্রতিবেদন দিয়ে ।
‘ইত্যাদি’ই প্রথম আন্তর্জাতিক তারকাদের সাক্ষাৎকার প্রচার করে। যেমন-শাহরুখ খান, মিঠুন চক্রবর্তী, ওয়াসিম আকরাম, সৌরভ গাঙ্গুলী। পরে অন্যরা তা অনুসরণ শুরু করেন। বিদেশি নাগরিকদের দিয়ে তাদের মাতৃভাষার বদলে বাংলা ভাষায় গ্রামের সহজ সরল মানুষের চরিত্রে অভিনয় করিয়ে তুলে ধরা হয় লোকজ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ খেলাধুলা।
তিনি একমাত্র উপস্থাপক যিনি কোনো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিয়মিত দর্শকদের গাছ উপহার দিয়েছেন। তার ভাষায় গাছ হলো ‘পরিবেশ বন্ধু’। টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের প্রযোজনা শিল্পে তাকে সেরা পথপ্রদর্শক বলা হয় । ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ টিভি অনুষ্ঠান হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পায় ‘ইত্যাদি’। পরবর্তীতে তিনি নতুনদের উৎসাহিত করার জন্য তাকে আর পুরস্কার না দেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান।
তিনিই একমাত্র উপস্থাপক যিনি ইত্যাদির পাশাপাশি ‘মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার’ অনুষ্ঠানেও দর্শক চাহিদায় সেরা উপস্থাপক।
হানিফ সংকেতের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক আনিসুল হক, যা আংশিক তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: প্রথম ইত্যাদি কবে করলেন?
হানিফ সংকেত: ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে বিটিভির প্রযোজনায়।
প্রশ্ন: আপনি ‘ইত্যাদি’ করছেন সুদীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে! বাংলাদেশে আমাদের একটা প্রবণতা হলো ধারাবাহিকতার অভাব। আমরা কোনো কাজে দীর্ঘদিন লেগে থাকতে পারি না। আপনার এই ধারাবাহিকতার রহস্য কী?
হানিফ সংকেত: আগে একটা নিয়ম ছিল, কোনো অনুষ্ঠানে বিরতি পড়ে গেলে তা আর করতে দেওয়া হতো না। ইত্যাদিতে যেন বিরতি না পড়ে, সে জন্য আমি বহুদিন বিদেশে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছি। আর আমি ইত্যাদি দর্শকদের মধ্যে বসে নিজে দেখতাম। এর ফলে মানুষের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ স্থাপিত হতো। মানুষ বলত, আপনি কখনো বন্ধ করবেন না, চালিয়ে যান। বয়স্করা দোয়া করতেন। আমি এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু সামাজিক কাজ করা শুরু করলাম। যুবসমাজ বিভিন্ন জায়গায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল। যেমন রাজশাহীতে ১১ জন বলে একটা অনুষ্ঠান করলাম। ওরা ১১১ জন হয়ে গেল। এই যে ভালো কাজের হোটেল। এরা তো ছোট করে শুরু করে। আরিফ আর নাজমুল দুজন। রাস্তায় টাকা তোলে। ঈদের সময় শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে গিয়ে দেখি, তারা বসে আছে কাচের বাক্স নিয়ে। আমিও কিছু টাকা দিলাম। তাদের কাছে জানতে চাইলাম বিশদভাবে। তারা আমার সঙ্গে দেখা করল। বুঝলাম, এদের কাজের স্বচ্ছতা আছে। ওরা শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। আমি ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখলাম, ঘটনা সত্য। শুধু চিকিৎসা করে না, গ্রামে গিয়ে শিশুদের আবার খোঁজ রাখে। আমি এদের নিয়ে প্রতিবেদন করলাম। আজ তাদেরই একজন আরিফের ‘ভালো কাজের হোটেল’ অনেক বড় হয়ে গেছে। পুরস্কার পাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। পলান সরকারের কথা জাতিকে ইত্যাদিই প্রথম জানায়। তিনি একুশে পদক পান। গহের আলী ১০ হাজার তালগাছ লাগিয়েছেন। আমি প্রতিবেদন করলাম। তিনি প্রথম পরিবেশ পদক পেলেন। এখন কয়েক লাখ তালগাছ তিনি লাগিয়েছেন। ইত্যাদিতে প্রচার করা গ্রিন সেভার্সের রনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, এ বছর পাচ্ছেন জাতীয় পরিবেশ পদক। এমনই আরও অনেকেই রয়েছেন, ইত্যাদিতে যাঁদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে, তাঁরা জনকল্যাণ ও মানবিক কাজে নিয়োজিত আছেন এবং মানুষের কল্যাণ করে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন: এত দিন ধরে ইত্যাদি হচ্ছে। সবচেয়ে মর্মস্পর্শী স্মৃতি কোনটা?
হানিফ সংকেত: আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কিশোরগঞ্জের হাওরের পানির ওপর ভাসমান একটি স্কুলের কথা। সেখানে যাতায়াতব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুর্গম। স্কুল ভবনটিতে বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল না। শ্রেণিকক্ষগুলোও ছিল বসার অনুপযোগী। আমরা ইত্যাদির পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন করি এবং যাতায়াতের জন্য বড় নৌকা, বিদ্যুৎ–সংযোগ স্থাপনসহ ভবনটির সংস্কারকাজ করি। যে স্কুলে শিশুরা একসময় ঝুঁকি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে স্কুলে যেত, তারাই এখন সুন্দর পরিবেশে আনন্দের সঙ্গে গান গাইতে গাইতে স্কুলে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আমি যখন ওই স্কুলে গেলাম, তখন যেন পুরো স্কুল আমাকে জড়িয়ে ধরল। একটা অন্য রকম পরিবেশ তৈরি হলো। সেই অভিজ্ঞতা অন্তর দিয়ে বুঝতে হবে। ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
প্রশ্ন : আপনি বললেন, আপনার এই যাত্রা দীর্ঘ। দীর্ঘদিন ধরে ১ নম্বর জায়গাটা ধরে রাখার রহস্য কী?
হানিফ সংকেত: রহস্য কিছুই নয়। আমার নিষ্ঠা, আমার আন্তরিকতা, অনুষ্ঠানের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং দায়বোধ।
প্রশ্ন : নতুন প্রজন্মের জন্য তিনটি উপদেশ দিন….
হানিফ সংকেত: প্রথমে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে কী করতে চায়, কী হতে চায়। তারপর তাকে পরিশ্রম করে যেতে হবে।
প্রশ্ন : কত দিন ইত্যাদি করার ইচ্ছা আছে?
হানিফ সংকেত: আমার কাছে দর্শকের রায় চূড়ান্ত। তবে সেটা সমকালীন ভিউ বিচারে নয়। দর্শক যত দিন চাইবেন এবং যত দিন আমার অনুষ্ঠান করার সক্ষমতা থাকবে, তত দিন ইত্যাদি করে যাব।
একদল অসৎ লোকের চেয়ে একজন সৎ লোক অনেক বড়, একদল অযোগ্য লোকের চেয়ে একজন যোগ্য লোক অনেক বড়, একদল অলস লোকের চেয়ে একজন কর্মঠ লোক অনেক বড়….. হানিফ সংকেত