চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য যুদ্ধ

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বানিজ্য যুদ্ধ, যা ২০১৮ সালে শুরু হয়, বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংঘাত।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কের ইতিহাস প্রাচীন হলেও, ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) যোগদান করার পর সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হয়। চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে। চীনের উৎপাদন খাতের বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক নীতি, এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৮ সালের মার্চে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, চীনের মেধাস্বত্ব চুরি ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের অভিযোগ ছিল এই শুল্ক আরোপের পেছনে মূল কারণ। চীনও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা তীব্র করে তোলে।

২০১৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের চীনের সাথে বাণিজ্যিক ঘাটতি ছিল প্রায় ৩৭৭ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় ছিল, যা ট্রাম্প প্রশাসনকে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাতে আগ্রহী করে।
যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, যে চীন মার্কিন প্রযুক্তি চুরি করছে এবং মেধাস্বত্ব চুরির মাধ্যমে মার্কিন প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।
চীনের “মেড ইন চায়না ২০২৫” পরিকল্পনা মার্কিন শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
চীনের “মেড ইন চায়না ২০২৫” পরিকল্পনার মাধ্যমে চীন উচ্চ প্রযুক্তি খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্যে কাজ করছে। এই পরিকল্পনা মার্কিন শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের অন্যতম কারণ।

২০১৮ সালের মার্চে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ইলেকট্রনিক্স, টেলিযোগাযোগ সরঞ্জাম এবং অন্যান্য পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করে। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করে যে এই পদক্ষেপ চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্যিক ঘাটতি কমাবে।
চীন মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, যার মধ্যে কৃষি পণ্য, গাড়ি, এবং অন্যান্য রপ্তানি পণ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। মার্কিন কৃষকদের জন্য এই পাল্টা শুল্ক অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র “ফেজ ওয়ান” চুক্তি স্বাক্ষরিত করে। চুক্তির আওতায় চীন মার্কিন পণ্যের জন্য অতিরিক্ত অর্ডার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং মেধাস্বত্ব চুরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। চুক্তি কিছু সমস্যা সমাধান করলেও, অনেক ইস্যু এখনও অমীমাংসিত রয়ে যায়।
২০২০ সালের নির্বাচনের পর, বাইডেন প্রশাসন চীনের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে। যদিও বাইডেন প্রশাসন পূর্ববর্তী শুল্ক এবং কৌশলগুলির কিছু অংশ বজায় রাখে, কিছু নতুন কৌশল ও নীতি পরিবর্তন আনে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য যুদ্ধ বৈশ্বিক বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়েছে এবং বহু কোম্পানিকে তাদের উৎপাদন চেইন পুনর্বিন্যাস করতে হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে।
মার্কিন কৃষকরা চীনের পাল্টা শুল্কের কারণে তাদের পণ্যের দাম কমে যাওয়ার শিকার হয়েছে। একইভাবে, চীনের উৎপাদকরা মার্কিন পণ্যের উচ্চ দাম এবং বাণিজ্যিক সীমাবদ্ধতার কারণে সমস্যায় পড়েছে। কিছু শিল্প কম্পানি তাদের উৎপাদন স্থানান্তর করেছে, যা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বানিজ্য যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দেশের বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে নতুন সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কৌশলের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।

ভবিষ্যতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আরও আলোচনা ও সমঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় এবং নতুন বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব হতে পারে। এই সমঝোতা বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশের স্থিতিশীলতার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা বৃদ্ধি পাবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হলে, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ভবিষ্যতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করবে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য যুদ্ধ একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যা যা বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কৌশলগত সমঝোতার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল বাণিজ্যিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। ভবিষ্যতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ও সমঝোতার মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে।

Tags

- Advertisement -