ছেলেটা কী করে খাবে: ঝিনেদার মিজান কাকাকে মনে পড়ে

শেখ মিজানুর রহমান

একসময় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মফস্‌সল শহরেই এমন কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা ছিলেন সাহিত্যসেবী, সংস্কৃতিপ্রেমী। জেলা শহরের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য তাঁদের প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। শহরে কেউ কবিতা–গল্প লিখছে, গান করছে—তাকে বিকশিত করার দায়িত্ব নিয়ে নিতেন তাঁরা। দিনে দিনে মফস্‌সল থেকে কমতে শুরু করেছে এসব আন্তরিক মানুষ। তাঁদের মধ্যে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে কেউ কেউ হয়তো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, কেউ বা মারা গেছেন। ঝিনাইদহ শহরের শেখ মিজানুর রহমান ছিলেন এমনই একজন। ২৫ এপ্রিল সকালে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। ঝিনাইদহের সাংস্কৃতিক বিকাশে তাঁর রয়েছে বিস্তর অবদান।

 

গীতাঞ্জলি সড়ক আর অগ্নিবীণা সড়ক—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী দুটি কবিতার বইয়ের নামে দুটি সড়ক আছে শহরে। ওই দুই সড়কের কোনো একটি দিয়ে হেঁটে চলেছেন টিংটিঙে গড়নের এক মানুষ। পান খেয়ে লাল হয়ে আছে পাতলা দুটি ঠোঁট। হাতে এক বান্ডিল কাগজ। হনহন করে হেঁটে চলেছেন। ঝিনাইদহ শহরের গীতাঞ্জলি কি অগ্নিবীণা সড়ক পার হয়ে কোথায় যাচ্ছেন তিনি? কারও সঙ্গে দেখা হলে ‘চলন্তিকা’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকার একটি কপি দিয়ে বলছেন, ‘আসছে শুক্রবার আসবেন কিন্তু সাহিত্য আসরে।’

শেখ মিজানুর রহমান—মিজান কাকার কথা মনে হলে এমন ছবিই বারবার ভেসে ওঠে আমার চোখে।

মিজান কাকা—ঝিনাইদহের আলো–হাওয়ায় বড় হওয়া মানুষ শেখ মিজানুর রহমান ২৫ এপ্রিল সকালে মারা গেছেন। মফস্‌সলের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা যেমন একটু নীরবে প্রস্থান করেন, জাতীয় গণমাধ্যমে তাঁদের প্রয়াণের খবরটি প্রকাশিত হয় টুটাফাটাভাবে, তিনিও অনেকটা সেভাবেই চলে গেলেন। তাঁকে কি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলতে পারি? নবগঙ্গা নদীর পেট চিরে বের হওয়া ঝিনাইদহ—আঞ্চলিকভাবে বলা হয় ঝিনেদা—শহরে শেখ মিজানুর রহমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন। মফস্‌সলের গন্ধঘেরা এই শহরে যদি কেউ কবিতা লেখে বা গল্প লেখে, অবধারিতভাবে তিনি সেই নতুন কবি বা গল্পকারের সহায়। গত ত্রিশ বছর এমনই ছিল দৃশ্যপট। তবে এখন থেকে সেই দৃশ্য আর থাকবে না। কারণ, মিজান কাকা এখন কবরে শুয়ে আছেন।

২৫ এপ্রিল সকালে ঢাকায় বসে ফেসবুক মারফত যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানলাম, সে সময় আমার কেবলই মনে পড়ছিল আমার ভয়ংকর শৈশবের কথা। স্মৃতির অতল খুঁড়ে ভেসে আসছিল এক ঘোরতর মফস্‌সলের কিছু মানুষের কণ্ঠস্বর:
‘এই ছেলে কী করে খাবে… নয়ন কী করে খাবে… ওর জীবনে কী যে হবে… আহা রে…!’

 

এসব বলত পাড়া–প্রতিবেশীরা। বলত আমার পরিবারের লোকজনও। খুব ছোটবেলায়, আমার বয়স যখন আট–নয়, তখন থেকে এমন কথা শুনতে শুনতে কীভাবে যে কুঁকড়ে যেতাম! প্রতিদিনই একটু একটু করে ছোট হয়ে যেতাম যেন!

যে বয়সে সবাই হাঁটতে শেখে, ওই বয়সে আমি হাঁটতে পারতাম না। আমার হণ্টন শুরু হয়েছে খানিকটা বড় হয়ে, ১০-১১ বছরে। আমার বাঁপায়ের শিরা একটু ছোট। ঠিক সময়ে তাই হাঁটতে পারিনি। কিন্তু এক পা, দুই পা করে একসময় যখন হাঁটতে শিখলাম, আমার সেই ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ চলা মোটেই আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো ছিল না, আমি হাঁটতাম খানিকটা পা টেনে টেনে, ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটা যাকে বলে। (এখনো সেভাবেই হেঁটে চলেছি)। তাই খুব শিশুকাল থেকেই ‘অসুস্থ’, ‘খোঁড়া’, ‘প্রতিবন্ধী’—এসব আমি বেশুমার শুনেছি। এখন যাকে ‘বুলিং’ বলে, তখন তো এই শব্দের মর্ম বুঝতাম না, কিন্তু বুলিংয়ের শিকার আমি হয়েছি। কেউ যে বুঝে এটা করতেন, এমন নয়। আর সেই আশির দশকে এ বিষয়ে এখনকার মতো এত সচেতনতাও ছিল না। সংগত কারণে প্রায় নিয়মিতই আমাকে শুনতে হতো, ‘ও তো হাঁটতে পারে না, ফুটবল খেলবে কী’ অথবা সেই চিরচেনা বাক্য, ‘এই ছেলে কী করে খাবে?’

Tags

- Advertisement -