বিবিএস তথ্য নির্ভরযোগ্য মনে করেন না এক তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারী

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তথা বিআইডিএস বাংলাদেশের একটি স্বায়ত্বশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান যা বাংলাদেশের উন্নয়নের নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের রূপরেখা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে থাকে ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বাংলাদেশের জনমিতি, স্বাস্থ্য , শিল্প ও শ্রম, জাতীয় হিসাব, মূল্য ও মজুরি, শিল্প উৎপাদন ও মূল্য সূচক, দারিদ্র্য, পরিবেশগত, জেন্ডার এবং কৃষি বিষয়ক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা এবং তথ্য পর্যালোচনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা এটি বাংলাদেশ সরকারের সকল ধরনের শুমারী ও জরিপ কার্যক্রম চালায় এবং কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সূচকের তথ্য প্রদান করে থাকে ।

যদিও বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারী পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন না। পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের অবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি অংশে আছে মূল্যস্ফীতি নিয়ে। বিবিএস এর অন্য সব তথ্য নিয়েও বিভিন্ন মত পার্থক্য দেখা যায়। এসব নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের একটি যৌথ জরিপে জানা যায় যে- ‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪’ নামে একটি জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। তাতে দেখা যায়- বিবিএস এর তথ্য ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশই সংস্থাটির পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন না বিশেষ করে মূল্যস্ফিতি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন রয়েছে তাদের।

জরিপে আরো উঠে এসেছে- মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বিবিএসের মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। ব্যবহারকারীদের ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মনে করেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কম। আর একেবারেই অনির্ভরযোগ্য মনে করেন ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।

বাংলাদেশে গত দুই অর্থবছরজুড়েই মূল্যস্ফীতির গড় হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও বিবিএস প্রকাশিত এ মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংস্থাটির দেয়া মূল্যস্ফীতির তথ্যের ব্যবধান অনেক বেশি বলে দাবি করে আসছিলেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকগন।
তাদের ভাষ্যমতে, বিগত সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বর্ণনা প্রচারের কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম বিবিএস। সংস্থাটিকে ব্যবহার করে জনসংখ্যা, জিডিপির আকার-প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই ভুল ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যান তৈরি ও উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পরও বিবিএস থেকে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে নানান প্রশ্ন রয়েছে।

সর্বশেষ চলতি মাসে প্রকাশিত মূল্যস্ফীতি প্রতিবেদনে দেশে আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার দেখানো হয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর আগে জুলাইয়ে দেখানো হয়েছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবার এক মাসের ব্যবধানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশীয় পয়েন্টেরও বেশি কমে যাওয়ার তথ্য দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরও আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক।
বনিক বার্তার এক প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ জিয়া হাসান জানায়- ‘দেশের মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। তাই একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে দেশের এ দুটি ডাটা চেক করা উচিত। স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও এসব ডাটা যাচাই করা যেতে পারে। কারণ এ দুই ডাটার ওপর ভিত্তি করে সুদহার নির্ধারণ করা হয়। তাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এসব ডাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

জরিপের তথ্যমতে, বিবিএসের তথ্যকে কম নির্ভরশীল মনে করে ৩৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ মানুষ। এর পরই ২৬ শতাংশ মানুষ ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দিহান। এর মাধ্যমে জিডিপির হিসাব-নিকাশ করা হয়। আর ২৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ আয় ও দারিদ্র্যের হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষের। ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ শিল্প, শ্রমিক ও শিক্ষা পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বিধায় থাকে। সর্বোপরি ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করছে, সংস্থাটির তথ্য নির্ভরশীল। আর প্রায় ১৯ শতাংশ মানুষ বিবিএসের তথ্যকে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনীয় মনে করছে। ৮০ শতাংশ ব্যবহারকারী বলছেন, প্রয়োজনীয় ডাটা পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত না।
জরিপে উঠে আসে সব মিলিয়ে ৩৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ ব্যবহারকারী মনে করেন, বিবিএসের তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়। এতে উঠে আসে, ৪২ দশমিক ৮৮ শতাংশ ব্যবহারকারী বিবিএসের তথ্য প্রকাশের ধারাবাহিকতা নিয়েও রয়েছে অসন্তুষ্ট। প্রায় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ ব্যবহারকারী এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিবিএসে পরিসংখ্যান প্রকাশে পেশাদারত্বের অভাব রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাটির কাজের স্বাধীনতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ফলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তথ্য-উপাত্তে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘবিরতি দিয়ে করা অনেক জরিপে আকস্মিকভাবে সংজ্ঞাগত পরিবর্তন আনায় অনেক সময় আগের জরিপের সঙ্গে তা তুলানও করা যায়নি। এজন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন ছাড়াও পরিসংখ্যানের লোকদের মাধ্যমে বিবিএস চালানো যেতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিবিএসে প্রফেশনাল দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। পরিসংখ্যানের লোক সেখানে নিয়োগ করা হয়নি। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় সেভাবে স্বাধীনতাও নেই প্রতিষ্ঠানটির। তাই রাজনৈতিক প্রভাবে পরিসংখ্যানে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। এখন বিবিএসের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। বিবিএসকে অবহেলার মধ্যে রাখা হয়েছে। যদিও এসিডিজির ১৬৯টি ইন্ডিকেটর বিবিএস থেকেই পাই আমরা। দীর্ঘবিরতি দিয়ে তারা লেবার, খানা আয়-ব্যয়সহ অনেক জরিপ করে। দেখা যায়, সংজ্ঞাগত পরিবর্তনের ফলে আগের জরিপের সঙ্গে নতুন জরিপের তথ্য অনেক সময় তুলনাও করা যায় না। বিবিএসে প্রফেশনাল দক্ষ লোক নিয়োগ করা উচিত।’

বিবিএসের উচ্চ পদগুলোয় প্রশাসন ক্যাডারের লোকবল বেশি থাকায় তারা সংস্থাটিকে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারেন না বলে মনে করছেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা (এসআইডি) বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম। এ বিষয়ে বলেন, ‘বিবিএসের উচ্চ পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের অনেক লোকজন আছে। এখানে পরিসংখ্যান ক্যাডারের লোক নিয়োগ করতে হবে। তা না হলে প্রশাসনের লোকজন সংস্থাটিকে ভালো করে গাইড করতে পারেন না। আর পরিসংখ্যানের পদ্ধতিগত উন্নতির মাধ্যমে মানুষের আস্থা আনতে হবে। এজন্য জনগণের সামনে জরিপের পদ্ধতি উন্মুক্ত রাখতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবহারকারীদের পরামর্শ নিতে হবে। টেকনিক্যাল কমিটিগুলোয় দেখা যায়, পরিসংখ্যানের লোকজনই বেশি থাকে। এখানে বাইরের অভিজ্ঞ লোকজন রাখতে হবে। মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় কিনা সেটা নজরে রাখতে হবে। অনেক সময় বাসায় বসেই জরিপের তথ্য পূরণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।’

আগে থেকেই বিবিএসের তথ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ছিল ১০০-এর মধ্যে ৮০ আর পদ্ধতিগত স্কোর ৭০। কিন্তু এর পর থেকে দুটি স্কোরই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সার্বিক স্কোর দ্রুত কমে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এ সূচকে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।

বিগত সরকারের আমলে ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। তখন মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডাটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। তাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর অভিযোগ ওঠে।
বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান একটি সুনামধন্য পত্রিকায় বলেন, ‘বিবিএসের অংশীজনের মতামত জানার জন্য এ জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। জরিপে ডাটার মান ও সময় নিয়ে মানুষের যেসব অসন্তুষ্টি উঠে এসেছে তা আমরা পরবর্তী জরিপ ও শুমারির সময় খেয়াল রাখব। তাৎক্ষণিকভাবে তো এসব সমাধান করা যাবে না। তাই পর্যায়ক্রমে আমরা এসব বিষয় মাথায় রেখে আমাদের পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পরিচালনা করব।’

Tags

- Advertisement -