লেখা – ড.এম.শাহ আলম
বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানের অধীন সকল নাগরিক ও মানুষ সমান অধিকার, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও সমান মানবিক মর্যাদার অধিকারী। এই অধিকার ও সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোন বৈষম্যকরণ নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠি, জন্ম, পেশা, জাত-পাত নির্বিশেষে সবার জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যেন কোন ব্যক্তি আইনগত অধিকার ও মর্যাদা বৈষম্যহীনভাবে ভোগ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশে এক বড় জনগোষ্ঠি রয়েছে যারা জাত-পাত, বর্ণ, পেশা, জন্ম ও অনেক রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সামাজিক কারণে তাদের আইনগত অধিকার ও মানবিক মর্যাদা পুরোপুরি ভোগ করতে পারেন না।
এই বিশাল জনগোষ্ঠি বাংলাদেশে যাদের সংখ্যা সত্তর লক্ষের বেশি, মূলত পরিচ্ছন্ন কর্মী, সুইপার, ডোমার, মুচি, ধোপা, কলু, চা বাগান শ্রমিক ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী এখন তারা অভিন্ন নাম দলিত হিসেবেই পরিচিত। এই নামেই তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন প্ররিচালিত। সমাজে এরাই সবচেয়ে অবহেলিত ও নিগৃত প্রান্তিক গোষ্ঠি। এছাড়াও হিজড়া, যৌনকর্মী, অনেক শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীও প্রান্তিক গোষ্ঠি হিসেবে নানা বৈষম্যের শিকার হন। আইনের দৃষ্টিতে তারা সব কিছুতে সমানাধিকারী হলেও নানান সামাজিক বঞ্চনা, অবহেলা, অবজ্ঞা, অস্পৃশ্যতা এবং খারাপ আচরণের শিকার। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনসহ অনেক নাগরিক সুবিধাদি প্রাপ্তিতেও তারা বঞ্চনার শিকার। তাদের পেশার বাইরে অন্য কোন পেশা বা পদে নিয়োগ পেতেও তারা প্রায়শ বৈষমের শিকার হন।
দলিত গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সামাজিক ও প্রসাশনিক অবিচার, বৈষম্য ও বঞ্চনা দূর করার জন্য অনেক দেশে বিশেষ আইন রয়েছে। আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিরও ব্যবস্থা রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনেও বৈষম্যর বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে এবং এর প্রতিকারের উপর জোর দেয়া হয়েছে। উল্লিখিত বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জাতিসংঘ চুক্তি সহ সকল প্রকার জাতিগত বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত বিষয় আন্তর্জাতিক সনদে বলা হয়েছে জাত-পাত, বর্ণ, জন্ম, অথবা জাতিগত জাতীয়, বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের কারণে কোন পার্থক্য, বিচ্ছিন্নতা, বঞ্চনা, অথবা পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করা, যার উদ্দেশ্য বা ফলাফল হচ্ছে জনজীবনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অন্য কোন ক্ষেত্রে সমভাবে মানবাধিকার এবং মৌল স্বাধীনতার স্বীকৃতি, ভোগ বা চর্চা বিনষ্ট বা ক্ষতি করা নিষিদ্ধ।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে দলিতদের বিভিন্ন সংগঠন ও এনজিও তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য বিলোপের জন্য সংগ্রাম করে আসছে যার একটি প্রধান দিক হচ্ছে এজন্য একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়নে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা। এক পর্যায়ে তারা আইন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কমিশন তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবন করে এ বিষয়ে কাজ করতে সম্মত হয়। এ কাজের প্রক্রিয়ায় আইন কমিশন এককভাবে এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ অনেক দলিত সংস্থা ও এনজিও এর সঙ্গে যৌথভাবে অনেক সেমিনার/ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠান করেছে। তাদের অবস্থা ভালভাবে অনুভব করার জন্য আইন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ একাধিকবার বিভিন্ন পরিচ্ছন্নতা কর্মী কলোনী বা পল্লীও পরিদশন করেছেন।
আইন কমিশন কর্তৃক সরকারের নিকট অনগ্রসর নাগরিকগণের অধিকার সুরক্ষা, সমান সুযোগ ও পূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বৈষম্য বিলোপ আইন বিষয়ে সুপারিশ একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠি এতে আশার আলো দেখেছে। বিভিন্ন মহল থেকে এর প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। সরকারের অনেক উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব বিষয়টির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। এর পক্ষে জনমত গঠনে গণমাধ্যম একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দলিতদের অবস্থার উন্নয়নে কোন আইন প্রণীত ও বাস্তাবায়িত হলে তা শুধু দলিতদের অবস্থারই উন্নয়ন ঘটাবে না, তাদের ন্যায্য সুবিধা ও মর্যাদা রক্ষার ফলে তাদের মধ্যে যে দেশ প্রেম ও কর্ম স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং মেধার স্ফুরণ ঘটবে তদ্দ্বারা দেশ ও আপামর জনসাধারণও অধিকতর লাভবান হবে। আমরা আশা করব সরকার কাল বিলম্ব না করে আইন কমিশনের সুপারিশ বাস্তাবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।