“ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে না হওয়াটাই বোধহয় ভালো। বিয়ে হলে মানুষটা থাকে ভালোবাসা থাকে না। আর যদি বিয়ে না হয় তাহলে হয়তো বা ভালোবাসাটা থাকে, শুধু মানুষটাই থাকে না। মানুষ এবং ভালোবাসা এ দুয়ের মধ্যে ভালোবাসাই হয়তো বেশি প্রিয়।”
“অল্প বয়সের ভালোবাসা অন্ধ গণ্ডারের মতো।
শুধুই একদিকে যায়। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, আদর দিয়ে এ গণ্ডারকে সামলানো যায় না।”
উক্তি গুলো করেছেন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে উপন্যাসিক নাট্যকার গীতিকার চলচ্চিত্র নির্মাতা সহ প্রায় সকল অঙ্গনেই পদ দর্পণ করেছিলেন। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় লেখক বলে গণ্য করা হয়। তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীর জনক, পাশাপাশি তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী প্রীতিকৃৎ নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি ছিলেন সমাদৃত।
১৯৭১ সালে হুমায়ূন আহমেদের বয়স ছিল ২৩ বছর, তখন তিনি থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানীদের হাতে গ্রেফতার হন।
১৯৮৮-১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার করেন নওয়াজিশ খানের প্রযোজনায় এবং হুমায়ুন আহমেদ এর রচনায় প্রথম টেলিভিশন ধারাবাহিক নাটক “বহুব্রীহি”। এই ধারাবাহিকদের প্রতিটি পর্ব ছিল বিষয়ভিত্তিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। যা ছিল বাংলাদেশের টিভি নাটকের অভিনব অধ্যায়। এ ধারাবাহিকের মাধ্যমে কিছু সামাজিক বিষয়ে যেমন মিথ্যা না বলা ও পুষ্টি সংরক্ষণের জন্য সপ্তাহে একদিন মাছ না খাওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাব যাগিয়ে তোলা ইত্যাদি। ধারাবাহিকের একটি সংলাপ “তুই রাজাকার” এটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
অয়োময় নাটকে তার মেয়ে শিলা আহমেদের অভিনয়ে অভিষেক হয়। শীলা আহমেদের অভিনীত আরেকটি জনপ্রিয় নাটক হচ্ছে “আজ রবিবার”। আহমেদ এই নাটকের মহড়া, চিত্রায়ণ ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন, যা তাকে পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।
তার রচিত আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক হলো “কেউ কোথাও নেই” (১৯৯০)। এই ধারাবাহিকের “বাকের ভাই”চরিত্রটি তুমুল দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে দর্শক ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে। এমনকি-হুমায়ূন আহমেদের ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে দর্শকেরা আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনি রমনা থানায় জিডিও করেছিলেন।
মিসির আলি চরিত্রটি হুমায়ুন আহমেদের মাথায় আসে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে স্ত্রী গুলতেকিনের সাথে গাড়িতে ভ্রমণকালে। এই ঘটনার অনেকদিন পর তিনি মিসির আলি বিষয়ক প্রথম উপন্যাস দেবী লিখেন। ১৯৮৫ সালে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচনা করেন নিশীথিনী (১৯৮৭), নিষাদ (১৯৮৮), অন্য ভুবন (১৯৮৯) ও বৃহন্নলা (১৯৮৯)। এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলিকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস দেবী থেকে ২০১৮ সালে নির্মিত হয় দেবী নামের একটি চলচ্চিত্র। যেটির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মিসির আলির বড় পর্দায় অভিষেক হয়। ছবিটি পরিচালনা করেন অনম বিশ্বাস। এতে মিসির আলির ভূমিকায় অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী।
হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট হিমু চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে ময়ূরাক্ষী উপন্যাস দিয়ে। ১৯৯০ সালে মে মাসে অনন্যা প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে চরিত্রটি পাঠকদের, বিশেষ করে তরুণ সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
শুভ্র চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাস দিয়ে। যদিও শুভ্র চরিত্রটি প্রথম আসে তার লেখা একটি ছোটগল্পে, যার নাম ‘শাদা গাড়ি।’ দারুচিনি দ্বীপ বইটি অনুপম প্রকাশনী থেকে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়। শুভ্রকে নিয়ে রচিত তার দ্বিতীয় উপন্যাস হল মেঘের ছায়া। এটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাসের গল্পের শেষ থেকে শুরু হয় পরবর্তী উপন্যাস রূপালী দ্বীপ (১৯৯৪)।
১৯৯২ সালে হুমায়ূন আহমেদ রচিত শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাস অবলম্বনে মোস্তাফিজুর রহমান একই নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
শঙ্খনীল কারাগার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের পুরস্কার লাভ করেন।।
২০০০ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় তার রচিত উপন্যাস বৃষ্টিবিলাস। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন নিয়ে লেখা বইটি তার সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের একটি। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই বইটির দ্বাদশ মুদ্রণ বের করতে হয়।
জীবনের শেষভাগে ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত দখিন হাওয়া ভবনের একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। খুব ভোর বেলা ওঠা অভ্যাস ছিল তার, ভোর থেকে সকাল ১০-১১টা অবধি লিখতেন তিনি। মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কখনো অবসর পেলে ছবি আঁকতেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তার রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো ‘গল্প-সমৃদ্ধি’। এছাড়া তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায়।তার গল্প ও উপন্যাস সংলাপপ্রধান। তার বর্ণনা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা তার রয়েছে। যদিও সমাজসচেতনতার অভাব নেই তবু লক্ষ্যণীয় যে তার রচনায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত। তিনি কোন চরিত্রে তার নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেননি। সকল রচনাতেই একটি প্রগাঢ় শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে এবং চরিত্রের বয়ানে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট নয়। তিনি চরিত্রের পক্ষপাত ও প্রবঞ্চনা থেকে দূরে থাকেন, যার ফলে ‘নেতিবাচক’ চরিত্রও তার লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ।এ বিষয়ে তিনি মার্কিন লেখক জন স্টাইনবেক দ্বারা প্রভাবিত। এছাড়া অনেক রচনার মধ্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির প্রচ্ছাপ লক্ষ্য করা যায়।
“আমাদের চোখের সামনে যা থাকে তার মূল্য দেইনা আমাদের চারপাশ ঘিরে থাকা ভালোবাসার কথা মনে রাখি না কিন্তু ভাসমান মেঘের মতো দেশে আসা ভালবাসাকে আমরা মনে রাখি”