লেখা-এরশাদ নাবিল খান
জীবিত অবস্থায় প্রতিভার মূল্য পাননি এই স্বভাব কবি। তিনি নিজেই বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর উত্তর প্রজন্ম তাকে স্বীকৃতি দেবে। সত্যিই পরে উর্দু এবং ফার্সি সাহিত্যের কবিদের মধ্যে তাকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি লেখা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। উপমহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বেই মির্জা গালিব এক জনপ্রিয় কবি-বিষাদের, প্রেমের, হাহাকার আর অতৃপ্তির অতুলনীয় কবি। সাহিত্যাকাশে মির্জা গালিব পূর্ণ চাঁদের মতো তার কলঙ্ক আছে কিন্তু তার জোছনার সৌন্দর্য, তার দ্যুতির কাছে রাত শেষে সবাইকে হার মানতে হয়।
নার্সিসাসের সৌন্দর্য আর আত্মপ্রেম তার জীবনহানির কারণ হয়েছিল। নার্সিসাসের যেখানে মৃত্যু ঘটে, ঠিক সেখানে খুব সুন্দর একটি ফুল জন্ম নেয় আর ওই ফুল পরিচিত হয় তার নামেই, ফুলের নাম নার্সিসাস। এ নার্সিসাস থেকেই নার্সিসিজমের ধারণা এসেছে, যা মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মবাদ, আত্মগর্ব, আত্মশ্লাঘার বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত করে। শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টিশীল জগতে এমন নার্সিসিস্ট, দাম্ভিক কিন্তু সহজাত প্রভিভার অধিকারী আশ্চর্য সৃষ্টিশীল মানুষের কথা চিন্তা করতেই প্রথমে মনে আসে একজন শব্দ জাদুকরের কথা- উর্দু এবং ফার্সি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি মির্জা গালিব।
এ মহাকবির জীবনালেখ্য, জীবন দর্শন আর যাপিত জীবনধারা সারল্যে ভরপুর। কবি হিসেবে তিনি কালোত্তীর্ণ হয়েছেন- মহাকাল শ্রেষ্ঠত্বের আসন তার জন্য ছেড়ে দিয়েছে বহু আগেই কিন্তু ব্যক্তি জীবনে মির্জা গালিব ছিলেন মারাত্মক হেঁয়ালি, বেহিসেবি, বেপরোয়া আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপনজনদের জন্য খুবই দায়িত্বশীল। নিজের প্রতিভা নিয়ে ছিলেন প্রচণ্ড দাম্ভিক, আত্মপ্রেমী, উদ্ধত কিন্তু জীবন আর জীবিকা নিয়ে তার বিশেষ কোনো মনোযোগ ছিলন। শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। জীবিত অবস্থায় তিনি যথাযোগ্য মর্যাদা পাননি। মৃত্যুর পর তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। মির্জা গালিব তাই একই সাথে নার্সিসিজম, দাম্ভিকতা, লাগামহীন ব্যক্তিজীবনের যেমন প্রতিভূ তেমনি সৃষ্টিশীলতা আর প্রভিভার কষ্টিপাথরে তিনি কালোত্তীর্ণ শ্রেষ্ঠ শব্দ জাদুকর।
মির্জা গালিবের জন্ম আগ্রায়, ১৭৯৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরে। তার আসল নাম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান। গালিব তার ছদ্মনাম। এর আগে তিনি ‘আসাদ’ ছদ্মনামে লিখালেখি করতেন। ‘আসাদ’ শব্দের অর্থ সিংহ আর ‘গালিব’ শব্দের অর্থ, সর্বশ্রেষ্ঠ, বিজেতা। নামের মতোই তিনি ছিলেন তেজি, দাম্ভিক আর শের স্রষ্টায় শ্রেষ্ঠ। যুক্তিবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করলেও তার বিশেষ ঝোঁক ছিল ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি।
তিনি উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হলেও ফার্সি ভাষার প্রতি গালিব ছিলেন অত্যানুরাগী এবং এ ভাষায় তার দখল ছিল ঈর্ষণীয়। উপনিবেশিক পরাধীনতার মাঝে গালিবের জন্ম গালিবের বাবা মির্জা আব্দুল্লাহ বেগ খান এবং চাচা মির্জা নাসিরুল্লাহ বেগ খান দুজনেই যখন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক হিসেবে নিহত হয়েছিলেন। তখন গালিব নেহাত একজন শিশু।
১৮১০ সালে ১৩ বছরের কম বয়সে গালিব নওয়াব ইলাহী বখশ খানের কন্যা ওমরাও বেগমকে বিয়ে করেন। মির্জা গালিবের ছোট ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। ছোট ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কখনও ছোট ভাইকে মুঘলদের থেকে প্রাপ্ত সরকারি ভাতা থেকে বঞ্চিত করতেন না, অর্ধেক ভাগ ভাইয়ের জন্য পাঠাতেন। পরে রাজভাতা অনেক কমে এলে ভাইকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। দিল্লির বাজার থেকে শুরু করে অলিগলির অনেকের কাছে দেনায় জড়িয়ে পড়েন মির্জা নওশা ওরফে গালিব।
কবিতার আসর বা মুশায়েরায় গালিবকে তার কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণে বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হতো। কিন্তু দাম্ভিক কবি গালিব এসব সমালোচনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলতেন- “আমি প্রশংসার কাঙ্গাল নই, পুরস্কারের জন্যে লালায়িত নই, আমার কবিতার যদি কোনো অর্থও না থাকে তা নিয়েও আমার তোয়াক্কা নেই।’ তার কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নিজের অহংকার এত প্রচণ্ড ছিল যে, তিনি মনে করতেন খুব কম লোকই তার কবিতাকে বিচার করতে সক্ষম। তবে মাঝে মাঝে সমালোচনার তীর তাকেও তীব্রভাবে বিদ্ধ করত বটে। গভীর হতাশায় গালিবকে তা উচ্চারণ করেন।
ইয়া রব, ও না সামঝে হ্যায় না সামঝেংগী মেরী বাত/দে অর দিল উনকো জো না দে মুঝকো জবান অর।”
অর্থাৎ, হে খোদা, সে না বুঝতে পারে আমাকে, না বুঝতে পারে আমার কথা/ তাকে দাও ভিন্ন হাদিয়, অথবা আমাকে দাও ভিন্ন বাচনভঙ্গি।
উর্দু আর ফার্সি সাহিত্যে শুধু কবিতা, শের বা গজলে গালিবের অবদান ছিল তা নয়। গদ্য সাহিত্যেও বিশেষত চিঠি লেখায় তিনি এক বিশেষ রীতির জন্ম দেন। তার রচিত দাস্তাম্বু রোজনামচা বা দিনলিপি তার গদ্য সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি যা একই সঙ্গে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশ কর্তৃক তা নির্মমভাবে দমনের এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে আজও। গালিব শুধু কবিতার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন না।
মির্জা গালিবের লেখায় রসবোধ ছিল প্রখর। একবার তার এক বন্ধুর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি বন্ধুকে চিঠি লিখেন
“আল্লাহ! আল্লাহ! ইয়ে এক বোহ হেয় যো তিন-তিন দফাহ্ ইস্ কায়েদ সে ছুট্ চুকা হ্যায় অওর এক হাম হ্যায়, কেহ আগলে পঞ্চাস বরাসসে যো ফাঁসিকা ফান্দা গ’লে মে’ পরা হ্যায় তো না ফান্দাহি টুটা হ্যায়, না দম্ হি নিকালতা হ্যায়।”
অর্থাৎ: আল্লাহ! আল্লাহ! আমাদের মধ্যে এমন মানুষও আছে যে তিন তিনবার বিবাহ নামের কয়েদখানা থেকে মুক্তিলাভের সৌভাগ্য লাভ করে। আর আমি একজন, যে গত ৫০ বছর ধরে এই কয়েদখানায় বন্দি, ফাঁসির দড়ির মতো যা আমার গলায় আটকে আছে। না দড়ি ছিড়ে, না আমি মরি।
শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, যিনি নিজেও একজন উঁচুমানের শায়ের ছিলেন। তিনি মির্জা গালিবকে সভাকবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর গালিবকে ‘নজম-উদ্-দৌল্লা, দবীর-উল-মুলক, নিজাম-ই-জঙ্গ, অর্থাৎ সাম্রাজ্যের তারকা, দেশের শ্রেষ্ঠ কবি, যুদ্ধের গরবী নায়ক) উপাধিতে ভূষিত করেন ১৮৫০ সালে।
কেবল খেতাবই দেননি, মির্জা গালিবকে নিজের ‘মুরশিদ’ বলেও মেনে নিয়েছিলেন। ‘মুরশিদ’ মানে দর্শনগুরু বা ওস্তাদ কিংবা ‘আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক’। আশ্চর্য খেয়ালী এ শিল্পী কখনও অর্থের জন্য কাজ করেননি। তার জীবিকা নির্বাহ হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অথবা ধার কর্য করে নতুবা কোনো বন্ধুর দানে। কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ তার জীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসে। মুঘল বাদশাহর সময়ে তিনি যে ভাতা এবং আনুকল্য লাভ করতেন, তা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বাতিল করেন। ফলে মির্জা গালিবকে তীব্র আর্থিক সংকটে পড়তে হয়।
চরম আর্থিক দারিদ্রদ্র্য আর দুরবস্থার মধ্যে ১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গালিব ইন্তেকাল করেন এবং তাকে দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের কাছে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। কোনো একসময় যদি আবারও ভারতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় তবে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের পাশাপাশি মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান গালিবের কবর জেয়ারত করার ইচ্ছা পোষণ করছি।