অটোমান সাম্রাজ্যের ভাই হত্যার কাহিনী

১৫শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর সময়টায় অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী সাম্রাজ্যগুলোর একটি। এর সামরিক শক্তি, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং কূটনৈতিক কৌশল সারা বিশ্বে বিস্তৃত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বিশাল ভূখণ্ডে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল অপরিসীম, এমনকি অটোমান সাম্রাজ্য তখনকার বৈশ্বিক রাজনীতির চেহারা বদলে দিয়েছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গৌরবময় ও প্রভাবশালী সময় ছিল সুলতান সুলেমান (উপাধি-দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট) এর শাসনামলে (১৫২০-১৫৬৬)। তাঁর নেতৃত্বে অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার বিশাল অংশে বিস্তৃত হয়েছিল এবং সামরিক শক্তি, স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে এক অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছিল। সুলতানের শাসনামলে অটোমান সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ সাফল্যে পৌঁছায়, যা সেই সময়ের বৈশ্বিক রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলে। তবে এই মহিমার আড়ালে লুকিয়ে ছিল রাজপরিবারের ভেতর ক্ষমতার লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস অধ্যায়। সিংহাসনের উত্তরাধিকারের জন্য রক্তাক্ত লড়াইয়ের অংশ হিসেবে প্রচলিত হয়েছিল ‘ফ্রাট্রিসাইড’বা ভাই হত্যা । এটি মূলত ছিল এক নিষ্ঠুর প্রথা, যা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার নামে মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করেছিল। যেখানে রাজতন্ত্রের নিরাপত্তার জন্য আত্মীয়ের রক্ত ঝরানোকে ন্যায়সঙ্গত মনে করা হতো।

তবে ফ্রেট্রিসাইডের প্রথা অটোমান সাম্রাজ্যের সূচনালগ্ন থেকেই বিদ্যমান ছিল না। বরং, অটোমান সাম্রাজ্য যখন পৃথিবীব্যাপী দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে এবং এত বড় সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সংঘাত দেখা দেয়, তখন এই প্রথার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৪শ ও ১৫শ শতাব্দীর দিকে অটোমান সাম্রাজ্যে ক্ষমতা উত্তরাধিকার প্রথা ছিল অত্যন্ত অস্থিতিশীল।

১৫৯৫ সালের একদিন। এটি সেইদিন যেদিন সুলতান মুরাতের মৃত্যুর পর তার সিংহাসনের ক্ষমতা উত্তরসূরী পুত্র মেহমেতের হাতে অর্পণ করা হয়। কিন্তু ইতিহাসে এই দিনটি স্মরণীয় থাকার কারণ নতুন সুলতানের আগমন নয় বরং ইস্তাম্বুলের রাজপ্রাসাদে ১৯ জন শাহজাদাকে (সুলতানদের পুত্র) হত্যার ঘটনা দিনটিকে স্মরণীয় করেছে। সেই সময়ে রাজ্যে প্রচলিত ভ্রাতৃহত্যার রাজকীয় ঐতিহ্য অনুসারে, নতুন সুলতান সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। ইস্তাম্বুলের নাগরিকরা রাস্তায় এত জন শাহজাদা হত্যার ভয়াবহতা ও শেষকৃত্যের মিছিল দেখে কেঁপে উঠেছিল। শুধুমাত্র ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্য নিজ ভাইকে হত্যার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্যি ভয়াবহ ও গা শিউরে ওঠার মতো।

প্রথাগতভাবে, সুলতানের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে একজন উত্তরসূরি হতেন। তবে, যেহেতু শাসকের একাধিক পুত্র থাকত, ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা একধরনের অনিবার্য সংঘাতে রূপ নিত। ক্ষমতার পালাবদলের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের কে নিজেদের ক্ষমতার পথে একটি বাধা হিসেবে গণ্য করতেন এবং সেই বাধাকে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় নেমে পড়তেন।

অটোমান সুলতান প্রথম মেহমেদ (১৪০২-১৪২১) আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রথার সূচনা করেন। তার পিতার মৃত্যুর পর, সাম্রাজ্যকে গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের হত্যা করেন এবং এককভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার শাসনকালে তিনি এই নীতি প্রবর্তন করেন যে, সুলতানের আসনে বসার পর তার প্রতিযোগী ভাইদের হত্যা করা হবে, যাতে রাজ্যের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের বিভেদ বা গৃহযুদ্ধ না ঘটে। এই প্রথার সূচনা হয়েছিল মূলত সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অজুহাতে।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি সমাজে সিংহাসনের দখল পেতে ভাই-বোন, পিতা-পুত্র এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে হানাহানি বা যুদ্ধের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এক্ষেত্রে অটোমান সাম্রাজ্যে ক্ষমতা দখল ও তা ধরে রাখার একমাত্র উপায় ছিল প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা। এটি একটি অদ্ভুত নীতি ছিল যেখানে ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সুলতানেরই ভাই। রাজবংশের উত্তরাধিকার প্রশ্নে ভাইদের মধ্যে যুদ্ধ ছাড়াই এককভাবে শাসন নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হিসেবে এই নৃশংস প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়।অটোমান রাজপরিবারে জন্ম নেয়া ভাইদের একটি উদ্বেগজনক পরিণতি অপেক্ষা করত। সুলতান হয়ে ওঠার জন্য যিনি সবচেয়ে ক্ষমতাবান, তার জন্য অন্য ভাইদের হত্যাই ছিল ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র পন্থা। ক্ষমতা দখলের পর প্রথম মেহমেদের উত্তরসূরিরাও এই একই নীতি অনুসরণ করেন, যাতে শাসন পরিচালনার জন্য অবিচ্ছিন্ন সংঘাত এড়ানো যায়।

ক্ষমতার জন্য নিকটতম আত্মীয়দের হত্যা করা কেবল একটি অমানবিক প্রথা ছিল না, বরং এটি শাসকের মধ্যে নিষ্ঠুরতার একটি কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। সুলতানের এই ধরনের নিষ্ঠুরতা রাজপরিবারের ভেতরে এবং বাইরের লোকদের মধ্যে শাসকের প্রতি ভয় এবং অবিশ্বাস তৈরি করেছিল।

১৬০৩ সালে সুলতান আহমেদ প্রথমের আমলে এই প্রথাকে আইনগতভাবে সমর্থন করা হয়েছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের আইনতন্ত্রে সুলতানের জন্য ভাইদের হত্যা করার অধিকার প্রবর্তন করা হয়েছিল, যাকে বলা হত “কানুনি কানুন”।

রেট্রিসাইডের একটি উদাহরণ হলো সুলতান সেলিমের ক্ষমতা দখলের সময়। তিনি তার দুই ভাই এবং বেশ কয়েকজন ভ্রাতৃপুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করেন যাতে শাসন নিরঙ্কুশ থাকে এবং রাজবংশের জন্য কোনও হুমকি না থাকে। এর ফলে, অটোমান সাম্রাজ্যে এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি হয় যেখানে ক্ষমতার জন্য যেকোনো ধরনের নৃশংসতা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

অটোমান সাম্রাজ্যে ভাই হত্যার এই প্রথা গভীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব ফেলেছিল। প্রথমত, এটি শাসকদের মধ্যে এক ধরনের ভয় এবং অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করেছিল। সাম্রাজ্যের শাসকরা সবসময় তাদের ভাইদের সিংহাসনে বসার ক্ষেত্রে নিজের জন্য হুমকি মনে করতেন, যা রাজপরিবারের মধ্যে ক্রমাগত অনিশ্চয়তা এবং সংঘাত সৃষ্টি করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে, রাজপরিবারের সদস্যরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য আলাদা থাকতেন এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতেন।

দ্বিতীয়ত, সাধারণ জনগণের মধ্যে এর প্রভাবও নেতিবাচক ছিল। যদিও সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ জনগণ প্রথাটি মেনে নেয়, তবু এটি জনসাধারণের মধ্যে সুলতানের প্রতি এক ধরনের ভয় এবং অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। সাধারণ জনগণও তাদের শাসকের নৃশংসতা এবং ক্ষমতার লড়াই সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল, যা সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থাকে একটি ভয়ানক উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করে।

এছাড়া ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ড এবং বিশেষ করে নিকটাত্মীয়ের হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত পাপ এবং নৈতিকভাবে নিন্দনীয়। অটোমান সুলতানদের এই ফ্রেট্রিসাইড প্রথা ইসলামের নীতি এবং বিধানের বিপরীত ছিল। ফলে, এই প্রথা সুলতানদের মধ্যে ধর্মীয় এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল।

তবে সুলতানরা “মসলাহা”বা বৃহত্তর জনস্বার্থের যুক্তিতে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতা দিতেন। তাদের মতে, এক ভাইয়ের জীবন বিলিয়ে দিয়ে সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা এবং লক্ষাধিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবুও, ফ্রেট্রিসাইডকে ধর্মীয় এবং সামাজিকভাবে কোনোভাবেই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি।

প্রাথমিকভাবে ভাই হত্যার জঘন্য প্রথাকে ক্ষমতার ঐক্য বজায় রাখার জন্য চালু করা হয়েছিল যাতে শাসক কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হয়।১৬০৩ সালে সুলতান আহমেদ প্রথমের সময় থেকে এই প্রথার অবসান শুরু হয়। তিনি তার ভাইকে হত্যা না করে তাকে বন্দি করে রাখেন। এর পর থেকে সুলতানদের মধ্যে ভাইদের হত্যার প্রথার পরিবর্তে “কেফেস”নামক একটি নতুন ব্যবস্থা চালু হয়, যেখানে সুলতানের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের বন্দী করে রাখা হতো। এই প্রথা ছিল মানবিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

ক্ষমতার জন্য শাসকদের মধ্যে যে নৃশংসতা এবং নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান ছিল, এটি তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।

যদিও এটি সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়েছিল, তবে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব শাসকদের নৈতিকতা এবং রাজপরিবারের মধ্যে ভয়ানক সম্পর্কের একটি উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে।এ ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবও পড়েছিল। ক্ষমতার লড়াই এবং এর নৃশংসতা অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি অন্ধকার দিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, যা ইতিহাসে শাসকদের ক্ষমতার সীমাহীন লড়াইয়ের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। অটোমান সাম্রাজ্যের ভাই হত্যার এ নীতি আমাদের আজও মনে করিয়ে দেয় যে ক্ষমতার লোভ কত ভয়ংকর এবং এর জন্য মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে।

Tags

- Advertisement -