ইউক্রেনীয় শস্যবাহী জাহাজে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

রাশিয়ার সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মধ্যে কৃষ্ণ সাগরে শস্যবাহী ইউক্রেনীয় জাহাজে ধারাবাহিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অভিযোগ নতুন করে উঠেছে। এই হামলা শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। মস্কোর এমন পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

গত সোমবার, রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে একটি পালাউ-পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ ‘অপটিমা’-তে, যা ওডেসা শহর থেকে ছেড়ে যাচ্ছিল। এই হামলায় একজন ক্রু সদস্য নিহত হন এবং পাঁচজন গুরুতর আহত হন। কয়েকদিন আগেই, রবিবার, সেন্ট কিটস এবং নেভিস পতাকাবাহী জাহাজ ‘প্যারেসা’ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, যা ৬,০০০ টন ভুট্টা বহন করছিল।

ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ওলেক্সি কুলেবা এই ঘটনাগুলোকে রাশিয়ার একটি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “মস্কো খাদ্য নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত কৃষ্ণ সাগরে শিপিং ব্যবস্থা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।” পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা এই পদক্ষেপকে “ইচ্ছাকৃত সন্ত্রাসী কৌশল” বলে অভিহিত করেন। এর আগে সেপ্টেম্বরে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো একটি বেসামরিক শস্যবাহী জাহাজ আক্রমণের অভিযোগ করেছিল, যা রোমানিয়ার কাছাকাছি কৃষ্ণ সাগরের জলে আঘাত প্রাপ্ত হয়।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, ‘আয়া’ নামের একটি শস্যবাহী জাহাজ, যা মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল, ইউক্রেনের জলসীমা ত্যাগ করার পরই রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়। সিবিহা এই হামলাকে “নৌ চলাচলের স্বাধীনতা এবং বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার উপর একটি নির্লজ্জ আক্রমণ” বলে উল্লেখ করেন।

এদিকে, রাশিয়া বরাবরের মতোই বেসামরিক জাহাজে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

ইউক্রেন, যা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শস্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত, যুদ্ধের মধ্যে তার খাদ্য সরবরাহ বজায় রাখতে চেষ্টারত। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে, তখন কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো অবরোধ করে দেয়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে, যা লেবানন, সোমালিয়া, মিশরের মতো দেশে সরাসরি প্রভাব ফেলে।

২০২২ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ চুক্তির অধীনে শস্য রপ্তানি পুনরায় শুরু হয়েছিল, কিন্তু এক বছর পরে রাশিয়া এই চুক্তি থেকে সরে যায়। এরপর ইউক্রেন নিজস্ব করিডোর ব্যবহার করে শস্য রপ্তানি করছে, যা রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং তুরস্কের আঞ্চলিক জলসীমার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে কৃষ্ণ সাগর এবং দানিউব নদীর বন্দরগুলোর মাধ্যমে ইউক্রেনের রপ্তানির পরিমাণ ২৫.১ মিলিয়ন টন ডেডওয়েট ছিল, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্লেষক পাভলো মার্টিশেভ বলেন, রাশিয়ার সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো ইউক্রেনের প্রতিযোগিতাকে হ্রাস করতে পারে, যার ফলে রাশিয়ার রপ্তানি আরো লাভজনক হয়ে উঠছে। ডেটা অনুসারে, রাশিয়া ২০২৩-২০২৪ বিপণন বছরে নতুন গম রপ্তানি রেকর্ড স্থাপন করেছে, যা ৫৫.৪ মিলিয়ন টন পণ্য রপ্তানি করে।

রাশিয়ার এ ধরনের হামলা ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। পাভলো মার্টিশেভ বলেন, “এই হামলাগুলো কৃষকদের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে, যাদের শীতকালীন ফসলের জন্য বীজ কিনতে নগদ অর্থের প্রয়োজন।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া শস্যবাহী জাহাজে হামলা করে শুধু ইউক্রেনকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করছে না, বরং এটি কৃষ্ণ সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনায় ভয় সৃষ্টি করছে। মস্কো এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে এই হামলার পেছনের কৌশল প্রকাশ না করলেও, ধারণা করা হচ্ছে এটি রাশিয়ার সাম্প্রতিক যুদ্ধজয়ের অংশ হিসেবে সংঘটিত হচ্ছে।

এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক শস্য বাজার এবং বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, যা ভবিষ্যতে আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হতে পারে।

Tags

- Advertisement -