ইস্পাত শিল্প তীব্র সংকটে উৎপাদন বন্ধের পথে

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের ইস্পাত শিল্পে ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটিয়েছে। চাহিদার ঘাটতি ও দাম কমায় শিল্পটি কঠিন সময় পার করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিক্ষোভ, কারফিউ এবং সাম্প্রতিক সরকারের পরিবর্তনের ফলে দেশের ইস্পাত খাত বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর প্রভাবে প্রধান প্রধান ইস্পাত কোম্পানিগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, এমনকি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে।

বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম এবং আনোয়ার ইস্পাত উভয়ই এই পরিস্থিতির উপর হতাশা প্রকাশ করেছে। বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, মিল মালিকেরা তাদের উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে কর্মীদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশে নির্মাণ খাতের প্রায় ৬৭ শতাংশ ইস্পাত চাহিদা সরকারি মেগা প্রকল্পগুলো থেকে আসে, তবে এসব প্রকল্পের কাজ গত আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে চাহিদার ঘাটতি আরও প্রকট হয়েছে।

এছাড়া দেশের রিয়েল এস্টেট খাতেও মন্দাভাব বিরাজ করছে। ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এই খাত সংকুচিত হয়েছে, যার প্রভাব ইস্পাতের চাহিদার ওপরেও পড়েছে। তপন সেনগুপ্ত জানান, এই সংকট মোকাবিলায় ইস্পাত কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য টনপ্রতি ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমিয়েছে। তবু, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না, বরং সংকট আরও গভীর হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, ৬০ গ্রেডের মাইল্ড স্টিল রড বর্তমানে প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগেও ছিল ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা।

ইস্পাত খাতের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আনোয়ার গ্রুপের মনোয়ার হোসেন জানান, মিলগুলো তাদের পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে না, যার ফলে তাদের পরিচালন ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। করোনা মহামারির পর মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সুদের হার ও মূল্যস্ফীতি ইস্পাত খাতকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। এছাড়া, ঋণপত্র মার্জিনের বৃদ্ধি, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যাঘাত এবং কাঁচামাল সংকটও এই খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে দেশের ইস্পাত কোম্পানিগুলো সংকটের কারণে উৎপাদন অন্তত ৬০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। কিছু মাঝারি আকারের মিল সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও মূলধন সংকটও ইস্পাত কোম্পানিগুলোর জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি নিয়ে আশাবাদী হলেও, নতুন কোনো সরকারি প্রকল্প গ্রহণ বা নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু না হলে এই খাতের চাহিদা ফিরবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, রাতারাতি পরিস্থিতির উন্নতি হবে না, তবে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে নির্মাণ প্রকল্পগুলো পুনরায় শুরু হলে চাহিদা ঘুরে দাঁড়াবে। তবে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সুমন চৌধুরী পরিস্থিতি নিয়ে এতটা আশাবাদী নন। তিনি উল্লেখ করেন, আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে কোনো সরকারি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি, যা ইস্পাত শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা। সরকারি খাত থেকে ইস্পাতের চাহিদা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, যা বার্ষিক মোট চাহিদার ৬৭ শতাংশ।

দেশের ইস্পাত বাজারে বর্তমানে প্রায় ২০০টি কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০টি বড় কোম্পানি। তবে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় এক কোটি ১০ লাখ টন হলেও চাহিদার সংকটে উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।

Tags

- Advertisement -