কাশ্মীর সমস্যা ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

লেখক- ব্যারিস্টার মুহম্মদ জমির উদ্দিন সরকার

মোগল সম্রাট ১৫৮৭ সালে কাশ্মীরে আসার আগে কাশ্মীর হিন্দু এবং মুসলমান শাসকদের দ্বারা শাসিত হতো। মোগলরা ১৭৫২ সাল পর্যন্ত শাসন করে। তারপর আফগান শাসকদের ৬৭ বছর শাসনের পর ১৮১৯ সালে শিখ রাজত্ব শুরু হয়। শিখরা ১৮৬৯-১৮৪৬ সাল পর্যন্ত শাসন করে। দু’টো বৃটিশ ও শিখ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হয়। লাহোর ও অমৃতসর শহরে চুক্তি দ্বারা বৃটিশ সরকার মহারাজা গোলাপ সিংহের কাছে কাশ্মির রাজ্য হস্তান্তর করেন। গোলাপ সিং এবং তার উত্তরাধিকারীরা এ পার্বত্য দেশ সিন্ধু নদীর পূর্ব্বে এবং ইরাবাতি নদীর পশ্চিম পর্যন্ত শাসন করেন। মহারাজা গোলাপ সিং বৃটিশ সরকারকে বছরে ৭৫ লক্ষ টাকা কর দিতেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালে মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে কাশ্মীর সংযুক্ত করেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটন তখন ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল। নিম্ন শর্তসাপেক্ষে তিনি রাজা হরি সিং-এর এ সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

“তাদের নীতির সাথে ধারাবাহিকভাবে যে কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে যেখানে যোগদানের বিষয়টি বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে, রাজ্যের জনগণের ইচ্ছা অনুসারে যোগদানের প্রশ্নটি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।”

এভাবে ভারতের সঙ্গে যোগদান করার জন্য পাকিস্তান বহু প্রতিবাদ করে। কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য এবং মুসলমানরা পাকিস্তানের সাথে যোগদান করতে ইচ্ছুক ছিলো। দু’রাষ্ট্রের ভিতরে শত্রুতা বেড়ে যায়। ভারতবর্ষ কাশ্মীরকে তার সংবিধানে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে সংযুক্ত করে। ভারতবর্ষ প্রথমে ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অভিযোগ করে যে, পাঠান উপজাতি পাকিস্তানের সাহায্য নিয়ে কাশ্মীর আক্রমণ করেছিল। ১৯৪৮ সালের ১৫ জানুয়ারী নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়টি উত্থাপিত হলে ভারতবর্ষের প্রতিনিধি জানান যে, ভারতবর্ষ কাশ্মীর ছেড়ে দিবে কি না অথবা পাকিস্তানে যোগদান করবে কি না অথবা কাশ্মীর স্বাধীন থাকবে কি না অথবা কাশ্মীর স্বাধীন থেকে জাতিসংঘের সদস্য পদ দাবি করবে কি না? এই সকল প্রশ্ন দেশে শুরু হলে কাশ্মীরের জনসাধারণ সিদ্ধান্ত নিবে। নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সালের ৩৯ নং সিদ্ধান্ত দ্বারা একটি কমিশন গঠন করেন এবং এ সমস্যা অনুধাবন করে মীমাংসা করার জন্য বলেন। ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসের ৪৭ নং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরের যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে ভারত এবং পাকিস্তান করাচীতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যুদ্ধ বিরতি রেখা নির্ধারণ করে। এটা জাতিসংঘের পরিদর্শকরা পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে জাতিসংঘ যুদ্ধ বিরতি সম্পর্কিত চুক্তির শর্ত লংঘনের অভিযোগ পান এবং এ অভিযোগ তদন্ত করে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট রিপোর্ট করতে বলেন। এভাবে রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কারণ ভারত কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের জন্য গণভোট দিতে অস্বীকার করে।

তদানীন্তন মহাসচিব  মি. ইউ টেনেন্ট কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি একটি বিমানের বাণিজ্যিক ফ্লাইটে পাকিস্তানের রাজধানীতে পৌছেন এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আলাপ-আলোচনার পর মি. ইউ টেনেন্ট তক্ষশিলা পরিদর্শন করেন যেখানে অতীতে একটি বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল।  মি. ইউ টেনেন্ট একজন বৌদ্ধ এবং পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তিনি তক্ষশিলা দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। অতঃপর তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লীতে গিয়ে তদানীন্তন ভারতবর্ষের প্রেসিডেন্ট সর্বপল্লী রাধা কৃষণ ও পরে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রির সঙ্গে আলোচনা করেন। শাস্ত্রি একজন বিনয়ী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনি মি. ইউ টেনেন্ট -এর যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি। ফলে মি. ইউ টেনেন্ট সমস্যার সমাধান ছাড়া খালি হাতে ফিরে আসেন। কারণ জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গণভোট দিলে কাশ্মীরের জনগণ পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে ভোট দিত। সেজন্য ভারত গণভোটে রাজী হয়নি।

যুদ্ধ বিরতি হোক বা না হোক ভারত কাশ্মীরে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করে। ফলে সমস্যা সমাধানের সকল পথ বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই দু’দেশের মধ্যে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আবার কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। কিছু দিন পর সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেস্কি কোসিগিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রি এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে তাসখন্দে মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু সেই চুক্তিতে যুদ্ধ বিরতির কথা থাকলেও কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। পাকিস্তান ও ভারত ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে ভারত এবং পাকিস্তানীদের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করে।

লন্ডনে ভারতীয় পক্ষকে সমর্থন করে বিবিসিতে মি: ক্রীক নামের একজন বৃটিশ নাগরিক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন এবং বলেন যে, যেহেতু ভারতবর্ষে গণতন্ত্র প্রচলিত আছে সে জন্যই তিনি চান যে, এ যুদ্ধে ভারতবর্ষ জয়লাভ করুক। অন্যথায় জনগণের কাছে গণতন্ত্র মূল্যহীন হয়ে যাবে। অন্যদিকে প্রবাসী পাকিস্তানীদের তরফ থেকে মিটিং-মিছিল করা হয়। তাতে পাকিস্তানী ছাত্ররা ভারতের আগ্রাসন নীতির নিন্দা করে পাকিস্তান স্টুডেন্ট হোস্টেল ও অন্যান্য জায়গায় সভা, শোভাযাত্রা করে প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানীরা অত্যন্ত জোর গলায় বলতে থাকে যে, তারা এ যুদ্ধে জয়লাভ করবেই। কারণ ভারতবর্ষ গণভোট অস্বীকার করতে পারে না। অন্যদিকে মুসলমানরা বহু বছর ভারত শাসন করেছে। সুতরাং কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ আন্দোলনের নেতা ছিলেন জনাব নাসিম আহমেদ। করাচির ডন পত্রিকার লন্ডনস্থ প্রতিনিধি। তার সঙ্গে পূর্ব্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা যোগ দেয় এবং সোচ্চার আন্দোলন করে।


পাকিস্তান ও ভারতের ছাত্রদের প্রতিনিধি নিয়ে বিবিসিতে সাক্ষাৎকার এবং বিতর্ক দেখান হয়। এতে উভয় পক্ষ নিজেদের যুক্তি-তর্ক তুলে ধরেন। বিবিসির সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের ছাত্ররা অকাট্য যুক্তি প্রদান করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, ভারত অন্যায়ভাবে কাশ্মীর দখল করে রেখেছে এবং তা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল জোর গলায় দাবি করেন যে, জাতিসংঘের অধীনে গণভোট হলে কাশ্মীর পাকিস্তানের অধীনে যোগদান করবে। যা হোক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর তাসখন্দ চুক্তির পর দু’দেশের এবং প্রবাসী পাকিস্তানী ও ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ প্রশমিত হয়। এই আন্দোলনে পূর্ব্ব পাকিস্তানের স্টুডেন্ট ফেডারেশন-এর নেতৃবৃন্দ ও প্রগতিশীল দলের যথেষ্ট অবদান ছিল।

Tags

- Advertisement -