খুলনা ‘কয়রায়’ বাঁধ নির্মাণের অজুহাতে কাটা হলো ৫০ হাজার গাছ

খুলনার কয়রা উপজেলায় নদীর তীরবর্তী এলাকায় বাঁধ নির্মাণের জন্য মাত্র আট মাসের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর চরের এসব গাছ বছরের পর বছর ধরে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা দিয়ে এসেছে। পরিবেশবিদ ও স্থানীয়দের অভিযোগ, গাছগুলো কেটে ফেলায় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

এ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তবে নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের দাবি, তারা গাছ কেটে ফেলেননি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, “এলাকার মানুষ নিজেরাই গাছ কেটে নিচ্ছেন, আমরা কেবল বাঁধের কাজ করছি।” তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, বাঁধ নির্মাণের অজুহাতে গাছ কেটে নেওয়ার ফলে উপকূলীয় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

কয়রার বিনাপানি, হরিহরপুর, গাববুনিয়া, বানিয়াখালী, গোলখালী, চরামুখা ও জোড়শিং এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর চরের গাছগুলো একে একে কেটে ফেলা হয়েছে। ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গাছ কেটে স্তূপাকারে রাখা হয়েছে। করাত দিয়ে গাছগুলো টুকরো করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাউবো থেকে তাদের বলা হয়েছিল, বাঁধ নির্মাণের জন্য চরের গাছ কেটে ফেলা যেতে পারে, মাটি সংগ্রহের জন্য জায়গা তৈরি করতে হবে।

বানিয়াখালী গ্রামের সোলাইমান সরদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “একটি গাছ বড় হতে বহু বছর সময় লাগে, কিন্তু এখানকার গাছগুলো মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ ছাড়া বাঁধ টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হবে, অথচ এখানে গাছগুলো নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে।”

কয়রা উপজেলাটি সুন্দরবনের নিকটবর্তী হওয়ায় নদীর জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা বীজ থেকে চরের গাছগুলো জন্ম নেয়, যা প্রাকৃতিকভাবে বাঁধকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। স্থানীয়রা জানান, বিগত কয়েক মাসে প্রায় ৫০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এই সবুজ বনই এতদিন ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঢাল হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু এখন সেই সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

বিনাপানি এলাকার বাসিন্দা বিপ্লব কুমার মণ্ডল বলেন, “ঝড়ের সময় এই বড় গাছগুলো বাঁধের ঢাল হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এখন যেভাবে গাছ কাটা হচ্ছে, তা বাঁধের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে।”

পাউবো সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়রার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর তীরবর্তী ৩২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া, ৩৭ লাখ টাকা বাজেটে বানিয়াখালী এলাকায় ১ হাজার ৩৫০ মিটার বাঁধ মেরামতের কাজও চলছে।

পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জসীম উদ্দীন বলেন, “বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে যেখানে গাছ কাটা হয়েছে, সেখানে পুনরায় গাছ লাগানো হবে। বন বিভাগের সঙ্গে দুই কোটি টাকার একটি চুক্তি হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে চরে বনায়নের জন্য চার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।”

তবে পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী বলেন, “গাছগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেরাই গাছ কেটে নিচ্ছেন, এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো হাত নেই।”

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, “গাছগাছালি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার পাশাপাশি বাঁধের মাটি আঁকড়ে ধরতে সহায়ক ছিল। গাছ ছাড়া এই বাঁধ টিকবে না। উন্নয়নের নামে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।”

পরিবেশবিদরা মনে করেন, বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি উপকূলীয় পরিবেশ ও স্থানীয় জনপদের সুরক্ষা দিতে হবে। গাছের গুরুত্ব অনুধাবন করে পরিকল্পনা নেওয়া না হলে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। স্থানীয়দেরও দাবি, পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে, যাতে উন্নয়নের পাশাপাশি প্রকৃতি ও জনপদের সুরক্ষা বজায় থাকে।

Tags

- Advertisement -