জনতা ব্যাংকের আর্থিক সংকট : ঋণ কেলেঙ্কারি ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফাঁদে আটকা

ছবিঃ বণিক বার্তা

জনতা ব্যাংক, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটের মুখে। সাম্প্রতিক নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকটি বিশেষ কিছু শাখার মাধ্যমে কয়েকজন প্রভাবশালী গ্রাহকের কাছে অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণ করেছে, যা প্রতিষ্ঠানটির তারল্য সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঋণের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি এবং ঋণের কেন্দ্রীভূতকরণ ঝুঁকির মুখে পড়েছে ব্যাংকের শাখাগুলো।

২০২২ সালে ব্যাংকটির ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কিছুটা কমে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে এ সময়ের মধ্যে ঋণের স্থিতি ৬৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকায়। দুই বছরে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এই ঋণের সিংহভাগই বিতরণ করা হয়েছে শীর্ষ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

জনতা ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা হলো বেক্সিমকো গ্রুপ, যার মালিকানা শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের। ২০০৯ সালের আগে ব্যাংকটিতে বেক্সিমকোর ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার কোটি টাকারও কম। কিন্তু বর্তমানে এই গ্রুপটির ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৮ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা খেলাপি। এস আলম গ্রুপ, এননটেক্স, ক্রিসেন্ট, ওরিয়ন, থার্মেক্স এবং রানকা গ্রুপের মতো অন্যান্য প্রভাবশালী গ্রাহকেরাও ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়েছে।

এদিকে, ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সূচনা হয়েছে বেশ কিছু প্রভাবশালী পরিচালকের হাত ধরে। জনতা ব্যাংকে দায়িত্ব পালনকারী পাঁচজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পরিচালিত পর্ষদে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রভাব বিস্তার করেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ড. আবুল বারকাতকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে আরও চারজন দায়িত্ব পালন করেন। এসব সময়কালে পর্ষদের পরিচালকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বলরাম পোদ্দার, নাগিবুল ইসলাম দীপু, মো. আবু নাসের, মো. মাহবুবুর রহমান হিরনসহ আরও অনেকেই জনতা ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন।

ব্যাংকটির সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, পরিচালনা পর্ষদে স্বাধীন মতামত দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রভাবশালী পরিচালকরা নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা সামনে রেখে ঋণ অনুমোদনের জন্য চাপ দিতেন। ঋণ বিতরণের প্রক্রিয়ায় নিয়ম নীতি মানার তেমন সুযোগ ছিল না, বরং রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত কিছু গ্রাহককেই বিশেষ সুবিধা দেয়া হতো। এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ বিতরণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বলরাম পোদ্দার ও নাগিবুল ইসলাম দীপু।

ড. আবুল বারকাত তার সময়কালে কোনো অনিয়মের কথা শোনেননি দাবি করলেও, তার অধীনস্থ পর্ষদেই এননটেক্স এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ গ্রহণ করে। ব্যাংকের ঋণ নীতির বাইরে গিয়ে যেসব ঋণ অনুমোদিত হয়েছিল, সেগুলো পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটির আর্থিক বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে দেখা দেয়। বলরাম পোদ্দার ও নাগিবুল ইসলাম দীপুর মতো পরিচালকেরা এসব ঋণ বিতরণের প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এমনকি এননটেক্সের কর্মকর্তারা বলরাম পোদ্দারকে ঋণের কমিশন দিতে গিয়ে ডাকাতির শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির পাশাপাশি তারল্য সংকটের আরেকটি বড় কারণ হলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাব। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এসএম আমিনুর রহমান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ অধিগ্রহণ করেন। এসব ঋণ পরবর্তীতে জনতা ব্যাংকের আর্থিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসএম আমিনুর রহমানের পর মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ, মো. আব্দুস সালাম এবং মো. আব্দুল জব্বারও রাজনৈতিক চাপের কারণে তাদের দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০২৩ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আব্দুল জব্বার জানান, তিনি অল্প সময় দায়িত্ব পালন করলেও ব্যাংকের ক্ষতি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন। তার আগের দায়িত্বের সময় তিনি ক্রেডিট কমিটির প্রধান হিসেবে বেক্সিমকোসহ অন্যান্য বড় গ্রুপের ঋণ অনুমোদনের প্রস্তাব পাস করান। তবে তিনি জানান, ঋণের নীতিমালা নির্ধারণ এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের পলিসির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে জনতা ব্যাংক তার আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালালেও, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত ব্যাংকটির পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব নয়।

Tags

- Advertisement -