টাকা পাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে প্রতিকার ব্যবস্থা

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে টাকা পাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার লক্ষণ নয়, বরং একটি গুরুতর অপরাধ যা দেশের অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রতিনিয়ত অগ্রসর হচ্ছে, টাকা পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশ থেকে যারা টাকা পাচার করেছে এবং টাকা পাচার করে, তারা পৃথিবীর কোনো দেশেই টাকার বালিশে সুখে-শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। দেশীয় আইনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনেও তাদের নাজেহাল করা হবে।” এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

দেশীয় আইনে প্রতিকার

১. আইনগত কাঠামো ও বিধি:

বাংলাদেশে টাকা পাচার মোকাবেলায় “অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২” একটি মৌলিক আইন হিসেবে বিবেচিত। এই আইন, পাচারের অভিযোগের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুস্পষ্ট বিধান ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে থাকে । এই আইনের আওতায়, অর্থ পাচার একটি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং এতে শাস্তির বিধান রয়েছে, যা অনূদিত দণ্ডনীয় অপরাধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এই আইনের আওতায়, পাচারের অভিযোগের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেন নজরদারি করা হয় এবং সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট করতে বাধ্য করা হয়। এতে করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত শনাক্তকরণ ও তদন্তের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।

২. অনুসন্ধান ও তদন্ত:

বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) অর্থ পাচার বিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। BFIU এর মূল কাজ হলো ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের পর্যবেক্ষণ করা, সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করা এবং তদন্ত শুরু করা। উদাহরণস্বরূপ, BFIU ২০২৩ সালে একাধিক বড় প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরে লেনদেনের মাধ্যমে পাচারের চক্র চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এদের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও অভ্যন্তরীণ যাচাইয়ের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

৩. অভিযোগ দায়ের ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী:

অর্থ পাচারের প্রমাণিত হলে, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন পুলিশ, র‌্যাব, এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (Anti-Corruption Commission) প্রাথমিক তদন্ত করে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে ব্যাংকিং সেক্টরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল যেখানে তারা অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাচার করেছিল। এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:

বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করে এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী অর্থায়নের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিকার-

১. Mutual Legal Assistance :

বিভিন্ন দেশের মধ্যে আইনি সহায়তা ও তথ্য আদান-প্রদান নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিশেষ চুক্তি রয়েছে যা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক তদন্ত পরিচালনায় সহায়তা করে। এই চুক্তির আওতায়, এক দেশ থেকে অপর দেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য যৌথ প্রচেষ্টা চালানো হয়।

২. ইন্টারপোল ও ইউরোপোল:

ইন্টারপোল ও ইউরোপোলের মতো আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাচারকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারপোলের মাধ্যমে ২০২২ সালে একটি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। এই অভিযানে একাধিক দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে পাচারকারীদের গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

৩. ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (FATF):

FATF আন্তর্জাতিক মানদণ্ড স্থাপন করে যা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উপর নজর রাখে এবং পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়নের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা প্রদান করে। বাংলাদেশের FATF-এর সদস্য হওয়ার কারণে, দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে এবং নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, FATF এর গাইডলাইন অনুযায়ী বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে পাচার প্রতিরোধের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

৪. ভালনেন্টার শেয়ারিং:

ভালনেন্টার শেয়ারিং বা আন্তর্জাতিক তথ্য আদান-প্রদান, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির মধ্যে, পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সংস্থার মাধ্যমে পাচারকারীদের শনাক্তকরণের জন্য তথ্য শেয়ার করেছে, যা পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করেছে।

৫. সুদূরপ্রসারী চুক্তি ও সম্মেলন:

জাতিসংঘের কনভেনশন (UNCAC) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। UNCAC সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং পাচারবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, UNCAC-এর সুপারিশ অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাচার প্রতিরোধে নিয়মিতভাবে নতুন আইনগত পরিবর্তন ও পর্যালোচনা করা হয়।

টাকা পাচার একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যা যা শুধুমাত্র দেশীয় আইনের মাধ্যমে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো, সহযোগিতা, এবং তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে এই সমস্যার প্রতিকার সম্ভব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, কার্যকরী আইন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা, আইনি কাঠামো, এবং তথ্য শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে, টাকা পাচারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। ড. আহসান এইচ মনসুরের কথায়, “বাংলাদেশ থেকে যারা টাকা পাচার করেছে এবং টাকা পাচার করে, তারা পৃথিবীর কোনো দেশেই টাকার বালিশে সুখে-শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। দেশীয় আইনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনেও তাদের নাজেহাল করা হবে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে।

Tags

- Advertisement -