ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমে বাড়ছে মৃত্যু

বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগী শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। এই সিনড্রোমের কারণে রক্তচাপ দ্রুত কমে যায়, রক্তের প্লাটিলেটের মাত্রা হ্রাস পায় এবং শরীরে তরল ব্যবস্থাপনার জটিলতা দেখা দেয়। এর ফলে অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন, কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুও হচ্ছে। শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক ফিভার নিয়ে বহু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। বিশেষত ঢাকার বাইরের রোগীদের মধ্যে শক সিনড্রোমের প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। এদের অধিকাংশই প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েই চলেছে। বুধবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ২০৭ নম্বর কক্ষের মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখা যায় সাড়ে তিন বছরের শিশু ইসমাইলকে। প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপতে থাকা শিশুটির হাতে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে, তার মা মরিয়ম বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। চিকিৎসকরা জানান, শিশুটি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে তার শক সিনড্রোমের উপসর্গ দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে আরও এক শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে, যার নাম জুরাইন ইয়াসার। তার মাও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রথমে ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ এলেও পরে পজিটিভ ধরা পড়ে এবং তখনই শিশুটির শারীরিক অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, শিশুদের মধ্যে ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক ফিভারের ঝুঁকি বেশি এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে মৃত্যুও হতে পারে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো সাইফুল্লাহ জানিয়েছেন, এই বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছেন। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের রোগীদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। গত বছরের তুলনায় এবারের ডেঙ্গু রোগীদের উপসর্গ কিছুটা ভিন্ন। বিশেষত শক সিনড্রোমের প্রকোপ বেড়েছে।

চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো, ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। জ্বরের সঙ্গে যদি তীব্র মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, বমি ভাব, শরীরের র‍্যাশ বা চোখের পেছনে ব্যথা দেখা দেয় তবে তা ডেঙ্গুর লক্ষণ হতে পারে। শারীরিক কোনো পরিবর্তন দেখলেই দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া উচিত। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ ডেঙ্গু রোগীদের দেওয়া যাবে না, কারণ এটি রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে আক্রান্ত হলে চোখে রক্ত জমে যায়, নাক, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত ঝরে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে পারে এবং তাই রোগীকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। বিশেষ করে শিশুদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। ডা. লুৎফুন নেছা জানান, শিশুর জ্বর হলে প্রথম দিনেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অনেক সময় অভিভাবকরা মৌসুমি জ্বর ভেবে অবহেলা করেন, যা বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বরের পাশাপাশি বমি, পাতলা পায়খানা এবং শরীরে লালচে র‍্যাশ উঠতে পারে, যা ডেঙ্গুর লক্ষণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৮৩ জন এবং তিনজন মারা গেছেন। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪০৫ জনে। একই সময়ে মারা গেছেন ১৯৯ জন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

দেশব্যাপী ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে এবং চিকিৎসকরা বারবার সতর্ক করছেন যে এই রোগের কোনো অবহেলা করা যাবে না।

Tags

- Advertisement -