তামাক শিল্পের বিকাশ ও বিএটি বাংলাদেশ এর আধিপত্য

বাংলাদেশের তামাক শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে তামাকের ব্যবহার অনেক পুরনো হলেও বর্তমান যুগে এটি একটি বিস্তৃত শিল্পে পরিণত হয়েছে। বিএটি (ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো) বাংলাদেশে তামাক শিল্পের প্রধান কোম্পানি হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশে সিগারেট উৎপাদন, বিপণন ও বিতরণ করে, যা দেশের তামাক শিল্পে অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান। এছাড়া, তারা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি রফতানিতেও সক্রিয়। তামাক বা সিগারেট মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হলেও দেশে এই শিল্পটি প্রতিনিয়তই বিকাশিত হচ্ছে যা খুবই আশ্চর্যজনক এবং উদ্বেগজনক। বিশেষ করে সিগারেটের বিক্রির পরিসংখ্যানগুলো এমন উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন দিকের উপর প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশে তামাক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিএটি বাংলাদেশের স্থান প্রথম সারিতে। বিএটি বাংলাদেশ সিগারেট উৎপাদন ও বিক্রয়ে একটি অন্যতম সফল কোম্পানি, যা দেশের তামাক শিল্পের বিস্তৃতিতে প্রধান ভূমিকা রাখছে। তাদের বিক্রির এই পরিমাণ বৃদ্ধির মূলে কোম্পানির বিজ্ঞাপন কৌশল, মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সরবরাহ ব্যবস্থার দক্ষতা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি দেশে তামাক পণ্যের উচ্চ চাহিদা, তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক ব্যবস্থা এবং অপ্রতুল জনসচেতনতা এর অন্যতম কারণ। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানির বিক্রির পরিমাণ ২২ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় একটি রেকর্ড। বিএটি বাংলাদেশের সিগারেট বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অগ্রগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যাও বাড়ছে, যারা সিগারেটের অন্যতম প্রধান ভোক্তা। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পর জনগণের সিগারেট ও তামাক জাতীয় পণ্যের প্রতি ঝোঁক ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি অবলোকন করলে দেখা যায় যে, বিশেষত নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত লোকেরাই এর প্রধান গ্রাহক। এদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হলেও তারা তাদের সামর্থ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই তামাক ও অন্যান্য নেশা জাতীয় পণ্য ক্রয়ের জন্যই ব্যয় করে। ফলে সিগারেট একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। অভ্যাসজনিত কারণে তাদের নিয়মিত চাহিদা বজায় থাকে, যা কোম্পানির বিক্রির লাভের পরিমাণের বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এছাড়াও, তরুণদের মধ্যে সিগারেটের প্রতি আকর্ষণ এবং ধূমপানের অভ্যাস দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা বিএটি বাংলাদেশের বিক্রি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

তাছাড়া বিএটি বাংলাদেশ তাদের পণ্য বিপণনে অত্যন্ত কৌশলী। তারা পণ্যের নানান ক্যাটাগরি তৈরি করে বিভিন্ন ক্রেতাস্তরকে লক্ষ্য করে বিপণন পরিচালনা করছে। সাশ্রয়ী মূল্যের সিগারেটের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারে ছাড়ছে, যা বিক্রি বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম বড় কারণ।

যদিও বাংলাদেশ সরকার ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন ট্যাক্স বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা প্রচার। কিন্তু এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারী আইন ও নিয়ন্ত্রণে অনেক ফাঁক রয়েছে, যা সিগারেট কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কৌশলকে সহজতর করছে।উচ্চ মানের পণ্যের সঙ্গে কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ডকে এমনভাবে প্রচার করছে, যা ভোক্তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করছে। তামাক বিজ্ঞাপন এবং বিপণন যদিও সীমাবদ্ধ, তবুও বিএটি বাংলাদেশ বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে সফল হচ্ছে।

একটি ক্ষতিকারক শিল্প হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে তামাক শিল্পে প্রতিযোগিতা তীব্র, যেখানে বিএটি বাংলাদেশ তার অবস্থান ধরে রাখছে এবং বলা যায় তা মূলত বক্তাদের সিগারেটের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণের কারণেই। যদিও অন্যান্য তামাক কোম্পানি যেমন ফিলিপ মরিস, আকিজ বিড়ি এবং ইমপেরিয়াল টোব্যাকো ইত্যাদি কোম্পানি গুলো দেশে তামাক শিল্পের প্রসার করছে।

বাংলাদেশে সিগারেট এবং অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশের একটি বড় অংশ তামাক ব্যবহার করে এবং এতে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত, কম বয়সী, মধ্য বয়সী থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অন্তর্ভুক্ত। ভোক্তাদের মধ্যে তামাকের চাহিদা তৈরি হয় সামাজিক এবং মানসিক প্রভাব থেকে। বিএটি বাংলাদেশ এই চাহিদাকে পূরণ করার জন্য তাদের পণ্যের বৈচিত্র্য এবং সহজলভ্যতা বজায় রেখেছে। তামাক পণ্যের প্রতি মানুষের আসক্তি এবং মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ বৃদ্ধি করে কোম্পানিটি কৌশলে তামাক পণ্যের বিক্রির হার প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তুলেছে। মানুষ এখন স্বাস্থ্য সম্পর্কে আগের থেকে বেশি সচেতন এবং তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জানলেও তারা নিজেকে কোন মতেই তামাক বা সিগারেট থেকে নিজেদের বিরত রাখছে না। মূলত  ভোক্তাদের এ উদাসীনতাকে কোম্পানিটির লাভের প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়।

তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে, যা বিএটি বাংলাদেশের মতো কোম্পানির ওপর সরাসরি ফেলেছে বলেই আপাত মনে হচ্ছে। যা অবশ্যই তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার একটি ভাল দিক। তবুও, তামাকজাত পণ্যের বিক্রি, বিজ্ঞাপন, এবং জনসচেতনতায় বেশ কয়েকটি বিধিনিষেধ থাকলেও বিএটি বাংলাদেশ এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলতে সক্ষম হওয়ায় তামাকের ওপর উচ্চ শুল্ক এবং কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও কোম্পানির উৎপাদন এবং বিক্রয় বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বন্ধ করা যাচ্ছেনা।

তামাক জাতীয় শিল্পের বিকাশের যদিও দেশের অর্থনীতিতে রাজস্ব আয় বাড়ছে, তবুও এ শিল্পের বিকাশকে এর নানা ক্ষতিকারক দিকের কারণেই নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু এর একটি ইতিবাচক দিক বলা যায় যে বিএটি বাংলাদেশের সিগারেট বিক্রির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব অর্জিত হচ্ছে। যেমন ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি টাকার যে বিপুল বিক্রি হয়েছে, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কর হিসেবে সরকার পেয়েছে। এই রাজস্ব আয় থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়নের মতো খাতে ব্যয় করা সম্ভব।

এছাড়া বিএটি বাংলাদেশে হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে।স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে তামাক কিনে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। তবে, তামাক চাষের কারণে কৃষিজমির ক্ষয় এবং কৃষকদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও রয়েছে।

অন্যদিকে তামাক ও সিগারেটের প্রধান নেতিবাচক প্রভাব হলো জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সিগারেট ধূমপান ক্যান্সার, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, ও স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ধূমপানের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে। বিএটি বাংলাদেশের বিক্রির ঊর্ধ্বগতি মানে, দেশের ধূমপায়ীদের সংখ্যাও বাড়ছে । যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

আবার তামাক চাষ ও উৎপাদন পরিবেশের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তামাকের জন্য জমির অতিরিক্ত ব্যবহার, বায়ু দূষণ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কার্বন নিঃসরণ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাছাড়া, সিগারেটের ফিল্টার ও বর্জ্য পদার্থ পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণ বাড়াচ্ছে।

তাই সহজেই বলা যায় বিএটি বাংলাদেশের মতো বড় কোম্পানির তামাক ব্যবসার বৃদ্ধির ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে। তাই ভবিষ্যতে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তামাকজাত পণ্যের উপর কর বৃদ্ধি করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ধূমপান নিরুৎসাহিত করার জন্য কঠোর নিয়মনীতি প্রণয়ন করা উচিত।

বিএটি বাংলাদেশ ছয় মাসে ২২ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকার সিগারেট বিক্রির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তবে, এর সাথে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকির কথাও সমানভাবে বিবেচনা করা জরুরি। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতার মাধ্যমে তামাকের নেতিবাচক প্রভাব কমানো সম্ভব। তামাক শিল্পের অর্থনৈতিক লাভের সাথে সাথে এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির বিষয়টিও আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে।

Tags

- Advertisement -