তালেবানের নীতি–নৈতিকতা আইন

আফগানিস্তানে সম্প্রতি তালেবান প্রণীত নীতি–নৈতিকতা বিষয়ক আইনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে, যা দেশটির জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। আফগানদের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে এ আইন। বিশেষত, তালেবানের নীতি পুলিশের মাঠ পর্যায়ের উপস্থিতি এবং সরকারের সদস্যদের নিপীড়নের ভয় দেশটির মানুষকে বাধ্য করছে এসব বিধিনিষেধ মেনে চলতে।

তিন বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর তালেবান রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসে। তখন থেকেই আফগান সমাজে বিশেষ করে নারীদের জীবনযাত্রা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে তালেবান নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে। তবে এবার নতুন আইনের মাধ্যমে তার কঠোর বাস্তবায়ন শুরু হলো।

তালেবানের নীতি–নৈতিকতা আইনটি আফগানিস্তানের সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আইনটির উদ্দেশ্য ইসলামের নীতি ও মূল্যবোধকে বজায় রাখা এবং ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রাকে সুরক্ষা দেওয়া। এই আইনটির মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা রয়েছে, যেগুলো বিশেষভাবে আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

নারীদের জন্য আইনটির ৩৫ নম্বর ধারা সবচেয়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই ধারায় বলা হয়েছে, নারীরা বাড়ির বাইরে উচ্চ স্বরে কথা বলতে পারবেন না। এভাবে নারীদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তাঁদের জন্য উচ্চ স্বরে গান গাওয়া কিংবা কবিতা আবৃত্তি করা নিষিদ্ধ। এর ফলে সৃজনশীলতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। নারীদের বিরুদ্ধে আরও একটি নিষেধাজ্ঞা হলো, তারা অনাত্মীয় কোনো পুরুষের দিকে তাকাতে পারবে না। এর ফলে নারী-পুরুষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে এবং এটি সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে।

এছাড়া, নারীদের বোরকা পরিধান করতে হবে শুধু পুরুষদের সামনেই নয়, অমুসলিম নারীদের সামনে থাকা অবস্থাতেও। পুরুষদের জন্যও কিছু কঠোর নির্দেশনা আরোপ করা হয়েছে। তাদের দাড়ি অবশ্যই মুষ্টির চেয়ে লম্বা হতে হবে এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করতে হবে। একইভাবে, পুরুষদের জন্য বলা হয়েছে যে, তারা নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ কখনো প্রদর্শন করতে পারবেন না।

তালেবানের নতুন আইনে সংবাদমাধ্যমের জন্য বিশেষ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম নিয়ে কোনো ধরনের উপহাস বা অবমাননাকর কিছু প্রকাশ করা যাবে না। সামাজিক মিডিয়া এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ইসলামিক মূল্যবোধের সঙ্গে অমিল কোনো কনটেন্ট প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এছাড়া, পরিবহন কোম্পানিগুলোকে নামাজের সময় অনুযায়ী তাদের যাত্রার সময়সূচি পরিবর্তন করতে বলা হয়েছে। মুসলমানদের অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা বা কোনো ধরনের সহযোগিতা না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সহযোগিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এমনকি কিছু ঐতিহ্যবাহী খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা দেশের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে জীবন্ত জিনিসের ছবি তোলা বা দেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে।

এছাড়া, নারীদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে। নারীদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তালেবান সরকার একটি বৈষম্যমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। অপরদিকে, শিশুদের পক্ষে মাতা-পিতার নির্দেশ অমান্য করাও বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।

এই আইনটি তালেবানের ইসলামী আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতা প্রকাশ করে এবং দেশের সমাজে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রাখে। তবে, এটি সমাজের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

তালেবানের নতুন নীতি-নৈতিকতা আইন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, বরং দেশের সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক ব্যবস্থাকেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আইনটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে আরো কঠোরতা আরোপের উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে, সংবাদমাধ্যমের জন্য কিছু বিশেষ নির্দেশনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে।

এছাড়া, সামাজিক মিডিয়া এবং টেলিভিশনে ইসলামিক মূল্যবোধের সঙ্গে অমিল কোনো কনটেন্ট প্রচার নিষিদ্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে একটি নজরদারি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা এখন তাদের পোস্ট এবং মতামত সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন, কারণ তারা জানেন যে তাদের কোনো কথাবার্তা কিংবা মত প্রকাশ তালেবানের নজরে পড়তে পারে। এটি একটি ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যেখানে মানুষ নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে বাধ্যবাধকতা অনুভব করছে। তাদের মৌলিক অধিকার, বিশেষত তথ্যের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার, এক ধরণের রাজনৈতিক বন্দিদশায় পড়ে যাচ্ছে।

সরকারের এই আইনটি অনেক ক্ষেত্রেই সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও নিউজ আউটলেটগুলো এখন ইসলামিক আদর্শের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য বাধ্য হচ্ছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার এই সংকটটি সমাজে তথ্যের মুক্ত প্রবাহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জনগণ সত্যিকার তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।

এভাবে, তালেবানের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক বিধিনিষেধ আইনটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপরই নয়, বরং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সমাজে সঠিক তথ্যের প্রবাহের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই বাস্তবতা সামগ্রিকভাবে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিকে আরো সংকীর্ণ করে দিচ্ছে, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

সমাজে পরিবর্তনের আলামত-

তালেবান সরকারের এই আইন ২১ আগস্ট ঘোষণা করা হয় এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা কার্যকর করতে মাঠে নামে পুলিশ। রাজধানী কাবুলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নীতি পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে নারীদের মাহরাম (পুরুষ আত্মীয়) ছাড়া বাইরে বের হতে বা হাত ও চুল উন্মুক্ত অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে নিষেধ করা হচ্ছে।

কাবুলের ২৩ বছর বয়সী এক তরুণ বলেন, “আমাকে তিনবার থামানো হয়েছে। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, কেন আমি দাড়ি রাখিনি। আমি ভয় পেয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে দাড়ি রাখব।”

মাজার-ই-শরিফের এক ট্যাক্সিচালক জানান, তাকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে কেন তিনি মাহরাম ছাড়া নারীদের গাড়িতে তুলছেন। এমনকি পারওয়ানের মতো জায়গায় মুখ না ঢেকে বাইরে বের হওয়ায় নারীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া কাবুলের একটি ব্যাংকে দেখা গেছে, নতুন আইনের প্রভাবে সব কর্মী পশ্চিমা পোশাক ছেড়ে ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক পরিধান করছেন।

পূর্বের বিধিনিষেধ ও বর্তমান আইন-

তালেবান গত ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাদের বিতাড়িত করার পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। নতুন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তালেবান সরকার দেশটির নারী ও পুরুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরির ওপর জোর দিয়েছে, এবং বিভিন্ন সামাজিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করেছে। পূর্বের নীতিগুলোর সাথে নতুন আইন সংযুক্ত করে তালেবান সরকারের লক্ষ্য হলো ইসলামী আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতা বজায় রাখা।

তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম থেকেই নারীদের শিক্ষা ও কাজের অধিকারকে হ্রাস করতে শুরু করে। মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, ফলে নারীদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘ সময়ের জন্য থমকে যায়। নারীদের বাইরে বের হওয়ার সময় তাদের সঙ্গে পরিবারের পুরুষ সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। এটি নারীদের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত সীমানা সংকুচিত করেছে। নারীদের প্রকাশ্যে বের হওয়ার সময় মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।

তালেবান সরকারের নির্দেশনাগুলোর মধ্যে নামাজের সময় অনুযায়ী সবকিছু পরিচালনা করার বাধ্যবাধকতা উল্লেখযোগ্য। এটা ধর্মীয় নিয়মের প্রতি তাদের অঙ্গীকার প্রকাশ করে, কিন্তু একই সাথে সামাজিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ধর্মের প্রভাব বাড়ায়। বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে পুরুষ ও নারীদের আলাদা থাকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে, যা সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ওপর ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করে।

নতুন আইনে কিছু পুরানো বিধিনিষেধকে পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, প্রকাশ্যে গান এবং জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারীদের জন্য নৈতিকতা রক্ষার অজুহাতে বাস্তবিক জীবনে কঠোর নিয়ম চালু করা হয়েছে, যা আগের অভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এছাড়া, তালেবানের নৈতিকতাবিষয়ক আইন সম্পর্কে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই বিধিনিষেধগুলোর প্রয়োগ অস্পষ্ট এবং ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। নতুন আইন বলছে, নারীরা ‘জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া বাড়ি থেকে বের হবেন না, তবে জরুরি পরিস্থিতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

এই আইনটির আরেকটি মূল বিষয় হলো, অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে আফগানদের আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো তালেবান সরকারের বিচ্ছিন্নতার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং আফগানিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াচ্ছে।

তালেবানের নতুন আইন ও পূর্বের বিধিনিষেধগুলো একত্রে আফগানিস্তানের সমাজে একটি অস্বাভাবিক এবং নিপীড়নমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এটি কেবল নারীদের জন্য নয়, বরং পুরুষদের জন্যও একধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছে। আফগান জনগণের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার এই প্রচেষ্টা মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি এক গভীর আঘাত হিসেবে বিবেচিত। এর ফলে, দেশটির ভবিষ্যৎ একটি অন্ধকার দিকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মানুষের স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে পড়ছে।

আইনের অস্পষ্টতা ও অসংগতির সমালোচনা-

তালেবানের নতুন নীতি–নৈতিকতা আইনটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে, তাতে অনেকেই উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, এই আইনটির অস্পষ্টতা এবং অসংগতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। প্রথমত, আইনটিতে উল্লেখ করা ‘জরুরি প্রয়োজন’ সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ফলে, নারীরা কোন পরিস্থিতিতে বাইরে বের হতে পারবেন এবং কোন পরিস্থিতিকে জরুরি বলে মনে করা হবে, তা সম্পূর্ণরূপে অজানা। এই বিষয়টি নারীদের স্বাধীনতার উপর একটি অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে একরকম অনিশ্চয়তা তৈরি করে।

আইনের অন্য একটি ধারা, যেখানে অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে। আফগানিস্তানের জনগণ যদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চায়, তবে তাদের জন্য এই নির্দেশনা বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এর ফলে, আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সংকুচিত হবে এবং দেশটি একঘরে হয়ে পড়বে, যা তালেবানের নিজেদের “একঘরে” স্ট্যাটাসকে আরও শক্তিশালী করবে।

আইনটি যে দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সংশয়ের অন্ত নেই। তালেবান সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনটির প্রয়োগের ব্যাপারে অসংগতি দেখিয়েছে। যে পরিস্থিতিতে কোনো নারীকে ‘মাহরাম’ ছাড়া বাইরে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে পুরুষদেরও একই ধরনের বিধিনিষেধ কার্যকর করা হয়নি। এটি আইনটির প্রয়োগে বৈষম্যের উদাহরণ সৃষ্টি করে। যদি নারীরা বাইরে বের হওয়ার সময় কাঠামোগতভাবে নিপীড়িত হয়, তবে পুরুষদের জন্য এমন নিষেধাজ্ঞার অভাব এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন বিষয়টি অসঙ্গতির দিকে ইঙ্গিত করে।

সংশয়ের একটি বড় জায়গা হলো, আইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। সাংবাদিকদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করে এবং ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিতর্কের ক্ষেত্রে প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত করে। সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন তৈরি করার অধিকার কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। এর ফলে, গণমাধ্যমের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার হুমকির মুখে পড়বে।

আইনের সংজ্ঞা এবং ধারাগুলোতে এই ধরনের অস্পষ্টতা এবং অসংগতি সমাজে অস্থিরতা এবং সন্দেহের জন্ম দেয়। মানুষের মনোজাগতিক অবস্থার ওপরও এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন একটি সমাজের সদস্যরা নিজের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে অনিশ্চিত থাকে, তখন তাদের জীবনযাত্রা এবং মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সর্বশেষে, তালেবানের এই নতুন আইন আফগানিস্তানের জনগণের জীবনযাত্রাকে যে এক নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আইনটির অস্পষ্টতা এবং অসংগতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে, যা শুধু সরকার নয়, বরং সমগ্র আফগান সমাজের জন্য একটি দুর্ভোগের কারণ হতে পারে।

জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া-

তালেবানের নীতি–নৈতিকতা আইন ঘোষণার পর জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত দ্রুত এবং সরাসরি। সংস্থাটি এই আইনকে একটি অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, এই নতুন আইনের মাধ্যমে আফগানিস্তানে নারীদের এবং বিশেষ করে তরুণীদের অধিকারগুলো নতুন করে হুমকির মুখে পড়বে।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নতুন আইন নারীদেরকে জনসম্মুখে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে বাধা দিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিগুলোর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তালেবানের এই আইন দেশের নারীদের জীবনে ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করছে, ফলে অনেকেই ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে।

জাতিসংঘ এই আইনের প্রসঙ্গে জানিয়েছে যে, তালেবানের ঘোষিত বিধিনিষেধসমূহ আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত মানবাধিকার নীতির প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে শিশু এবং যুবসমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই আইন বাধা সৃষ্টি করবে। সেখানে নারীদের জন্য শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি গুরুতর হুমকি।

এছাড়া জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন, তালেবান সরকারের নীতি কেবল নারীদের স্বাধীনতার ওপরই প্রভাব ফেলছে না, বরং পুরো সমাজকে নিষ্ঠুর ও অমানবিকভাবে পরিচালিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এই প্রেক্ষাপটে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে যে, তারা যেন তালেবানের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে এবং আফগানিস্তানের জনগণের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানিয়েছে যে, তালেবানের নীতি–নৈতিকতা আইন বাস্তবায়নের ফলে দেশটির মানুষের জীবনে এক ধরনের অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিশেষ করে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা মানুষের মনোবলকে ভেঙে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা প্রদানের উপর জোর দিয়ে বলেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য এ দেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো অপরিহার্য।

সার্বিকভাবে, জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া আফগানিস্তানে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, যাতে তালেবান সরকার মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং নারীদের প্রতি নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধ করে।

Tags

- Advertisement -