নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে ভোক্তার পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি এখন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। পাইকারি সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ভোক্তারা প্রতিদিনই নতুন সংকটে পড়ছেন। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও, বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে। পুরোনো সিন্ডিকেট নতুন কৌশলে সক্রিয় হয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, ফলে প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

বাজারে ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে ডিম, সবজি এমনকি চালের দামও লাগামহীনভাবে বাড়ছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতিদিনই ক্রেতারা বাড়তি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও পাইকাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারের ওপর প্রভাব বিস্তার করছেন। ঢাকার প্রধান বাজারগুলোর চিত্র দেখলে বোঝা যায়, কীভাবে পাইকারি পর্যায়ে অতি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছেন।

বিশেষ করে ডিমের বাজারে চলছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। রাজধানীর ২২ জন ব্যবসায়ী মিলে সিন্ডিকেট করে ফার্ম থেকে কম দামে ডিম কিনে তা চড়া দামে বিক্রি করছেন। ফার্ম থেকে ১১ টাকায় কেনা ডিম আড়তে ১৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে খুচরা বাজারে এই ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬ থেকে ১৮ টাকায়। এক মাস আগেও যা ১২ টাকা ছিল। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এই ২২ জন ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু আড়ত বন্ধ করে দিয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানি এবং ডিম ব্যবসায়ী সমিতি মিলে ডিম ও মুরগির বাচ্চার অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে ২০ দিনে ২৮০ কোটি টাকা লুটপাট করেছে। সংগঠনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেছেন, প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ২৯ পয়সা হলেও ভোক্তার কাছে সেই ডিম পৌঁছাতে ১৫ টাকা পর্যন্ত দাম পড়ছে। এ ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে মুরগির বাচ্চা এবং ফিডের খরচ কমাতে পারলে বাজার দ্রুত সহনীয় পর্যায়ে ফিরে আসতে পারে।

ভোজ্যতেলের বাজারেও একই পরিস্থিতি। খোলা সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে লিটারে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে খুচরা বাজারে দাম বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের তদন্তে দেখা গেছে, পাইকারি বিক্রেতারা মিল থেকে কম দামে তেল কিনেও বেশি দামে বিক্রি করছেন, ফলে খুচরা পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সবজির বাজারেও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেগুন, বরবটি, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা থেকে শুরু করে প্রায় সব সবজির দাম বেড়েছে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচের দাম ছিল ১৮০ থেকে ২২০ টাকা, যা তিনদিনের মধ্যে বেড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় পৌঁছেছে। বরবটির দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ধনেপাতা বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

বাজারে অস্থিরতার পেছনে একদিকে ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক মুনাফার লোভ এবং অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল জানিয়েছেন, আড়তদাররা মূলত ডিমের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ২২ জন ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অভিযানের ফলে ডিমের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। একইভাবে ভোজ্যতেল এবং ব্রয়লার মুরগির দাম নিয়েও তদন্ত চলছে। আশা করা হচ্ছে, কয়েকদিনের মধ্যেই পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।

সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু পণ্যের শুল্ক ও কর কমানো হয়েছে, পাশাপাশি টাস্কফোর্স গঠন করে বাজার তদারকি বাড়ানো হয়েছে। তবে এতেও বাজারে স্থিতিশীলতা আসেনি। ব্যবসায়ীরা সরকারের সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করছে। বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকায় ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফা করেই যাচ্ছেন।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব এবং সিন্ডিকেটের প্রভাবের কারণে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না, ফলে বাজার ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।”

সরকারের পক্ষ থেকে বাজার স্থিতিশীল করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে তার সুফল পেতে বেশ সময় লাগছে। সিন্ডিকেটের প্রভাব ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ভোক্তাদের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের এই ধারা চলতেই থাকবে।

Tags

- Advertisement -