পতেঙ্গা টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পেছনের গল্প

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতি বছর পাঁচ লাখ টিইইউ (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল। অথচ নির্মাণের দুই বছরেরও বেশি সময় পরও, বিদেশি অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) টার্মিনালটির সক্ষমতার মাত্র ৮ শতাংশ ব্যবহার করছে, যা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য এক বিশাল আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পিসিটি পরিচালনার দায়িত্ব সৌদি আরবভিত্তিক আরএসজিটিআই-এর হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং দেশীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও বিনিয়োগ ছাড়াই আরএসজিটিআই লাভবান হচ্ছে। তারা আরও দাবি করেন, সংস্থাটি টার্মিনালের আয় থেকেই সরঞ্জাম কিনছে, যা আর্থিকভাবে অবাস্তব।

চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যান্য টার্মিনালগুলো থেকে সিপিএ প্রতি কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৮০-৯০ মার্কিন ডলার আয় করে, যেখানে পতেঙ্গা টার্মিনালে আরএসজিটিআই কর্তৃক সিপিএকে দেওয়া হয় মাত্র ১৮ ডলার। এমনকি টার্মিনালটির আংশিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আরএসজিটিআই প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৭৮ টিইইউ কন্টেইনার পরিচালনা করতে পেরেছে, যা তার সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম। আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে বিনিয়োগকারীরা এবং পিসিটির কর্মকর্তারা টার্মিনালের দুর্বল কার্যকারিতার জন্য সরঞ্জাম সংকটকে দায়ী করছেন।

২০১৯ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এরপর, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য নিবন্ধিত আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে, সাবেক চেয়ারম্যান এম শাহজাহানসহ একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলের চাপেই এ চুক্তি বাস্তবায়িত হয়। ওই সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গা টার্মিনাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার সক্ষমতা থাকার পরও চুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

শাহজাহান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো চিঠিতে দেশের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তার দাবি, টার্মিনালটি নিজেই পরিচালনা করলে বন্দর কর্তৃপক্ষের আয় হতো বছরে ৫৪৬ কোটি টাকা। তবে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা চুক্তি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখায় পতেঙ্গা টার্মিনালের কার্যক্রম আরএসজিটিআই-এর হাতে চলে যায়, যা আজ আর্থিক ও কার্যক্ষমতার দিক থেকে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী, আরএসজিটিআই-কে ১,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা ছিল, যার ৭০ শতাংশ ঋণের মাধ্যমে আসার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তারা মাত্র ২২০ কোটি টাকার একটি অগ্রিম ছাড় দিয়ে টার্মিনালের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, যা পিসিটি নির্মাণের মোট বিনিয়োগের মাত্র ৯ শতাংশ। তাছাড়া, বন্দরটি সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও এখন পর্যন্ত টার্মিনালে আনা হয়নি।

বিশেষ করে আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে আরএসজিটিআই এখনও স্ক্যানারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম না আনায় টার্মিনাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছাড়াই পিসিটি কেবল কিছু রপ্তানি কন্টেইনার পরিচালনা করছে। এছাড়াও, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের রাজস্ব ক্ষতির সম্ভাবনা আরও প্রকট হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর প্রভাবেই চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়। সাবেক আইএফসি কর্মকর্তা সুমায়া মাহমুদ এ প্রক্রিয়ার ত্রুটি সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা করলেও তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া হয়।

বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতের ঋণদানকারী সংস্থা আইএফসি পিসিটির চুক্তি প্রণয়নে এবং অন্যান্য বিনিয়োগে প্রভাব রেখেছিল, যা এখন দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হচ্ছে। সাবেক কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, আরএসজিটিআই-এর চুক্তির শর্তগুলো ভবিষ্যতের বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনালের মতো প্রকল্পগুলোর জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক কর্মকর্তারা এবং দেশীয় ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পতেঙ্গা টার্মিনালের চুক্তি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ক্ষতি। তারা মনে করছেন, টার্মিনালটি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে দেশীয় অপারেটরদের হাতে থাকলে বন্দর এবং দেশের রাজস্ব আরও বাড়তো। সিপিএ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান যদিও চুক্তিকে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয় বলে দাবি করছেন, তবে বাস্তবিকভাবে পতেঙ্গা টার্মিনালের সক্ষমতা এখনও যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

Tags

- Advertisement -