পাট শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা

পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম স্থানে থাকলেও এই সম্ভাবনাময় খাত থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। রপ্তানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, তবে পণ্য বৈচিত্র্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট পিছিয়ে থাকা লক্ষণীয়। উদ্যোক্তারা বলছেন, পাটপণ্যের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তি এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাব অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।

একটি উদাহরণ হিসেবে, ভারতে পাটের ফেব্রিকের সংখ্যা ২০০টিরও বেশি, যেখানে বাংলাদেশে মাত্র তিনটি ক্যাটাগরিতে ১০ ধরনের ফেব্রিক পাওয়া যায়। এই বিশাল ব্যবধান পাটের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করছে। পাট পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ২২ বছর আগে গঠিত জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) এই খাতে অনেক বড় ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও তা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে ২০১৭ সালে, তবে প্রচারণার অভাবে এটি এখনও অনেকের কাছে অজানা।

.

রাজধানীর মণিপুরীপাড়ায় অবস্থিত জেডিপিসির বিক্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সঞ্চিতা দাশের মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। তিনি এক ব্যাংকার, যিনি পাটের পণ্য ব্যবহারে বিশেষ আগ্রহী। তবে সেখানে গিয়ে তিনি পণ্যের নতুনত্বের অভাবে হতাশ হয়েছেন। সঞ্চিতা বলেন, পাটের জুতা বা পোশাকগুলো সারাবছর ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি হয়নি। এর ফলে সামগ্রিকভাবে পাটপণ্যের বিক্রি বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

জেডিপিসির পরিচালক সীমা বোসের মতে, পণ্যের প্রকরণ ও বৈচিত্র্যের অভাবে দাম কমানো এবং বৈশ্বিক মানের সাথে সামঞ্জস্য করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রচারের ক্ষেত্রেও জেডিপিসির বড় দুর্বলতা রয়েছে। যদিও তাদের ওয়েবসাইট, ফেইসবুক পেইজ এবং ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে, তবু তা কার্যত অকার্যকর। ফেইসবুক পেইজে মাত্র ১০ হাজার লাইক, যা এমন একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অপ্রতুল।

উদ্যোক্তা আনিকা জাহান মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের অভাব সত্যিই দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, মণিপুরীপাড়ার মতো জায়গায় বিক্রয়কেন্দ্রের অবস্থানের কারণে অনেকেই জেডিপিসি সম্পর্কে জানেন না।

সীমা বোস অবশ্য জানান, আগামী বছর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব চ্যানেল ও অ্যাপের মাধ্যমে প্রচার কার্যক্রম জোরদার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, বাণিজ্যিক এলাকায় শাখা খোলার উদ্যোগও চলছে।


পণ্যের মান বাড়াতে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি এখনো দেশের পর্যাপ্তভাবে নেই বলে স্বীকার করেছেন জেডিপিসির পরিচালক। ভারতে যেখানে ২০-৩০ টাকার মধ্যে বড় পাটের ব্যাগ পাওয়া যায়, সেখানে বাংলাদেশে এর খরচ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মতো। ফলে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

জেডিপিসির সক্রিয় উদ্যোক্তা সদস্য সংখ্যা প্রায় ৯৮৭ জন, এর মধ্যে ৩০০ জন বিক্রয়কেন্দ্রে পণ্য সরবরাহ করেন। তবে এই সদস্যদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তির ব্যবস্থা না থাকায় তারা যথাযথভাবে অগ্রসর হতে পারছেন না। যদিও সরকারি সাইটে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু জেডিপিসির নিজস্ব কোনো আবেদন ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া ২১ দিনের প্রশিক্ষণ সঙ্কুচিত হয়ে ৫ দিনের মধ্যেই শেষ করা হচ্ছে, যা কার্যকর প্রশিক্ষণ প্রদানে বড় বাধা।


জেডিপিসির কার্যক্রম নিয়ে উদ্যোক্তাদের অভিযোগের শেষ নেই। নুপুর ফ্যাশন ও হ্যান্ডিক্রাফটের উদ্যোক্তা নুপুর খানম জানান, তিনি জেডিপিসির সঙ্গে কাজ করতে অনাগ্রহী, কারণ সেখানে ‘কমিশন বাণিজ্য’ চলে এবং তার ডিজাইন নকল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, বিডি জেপিএমইএ সমিতির সদস্য মেহেদি হাসান ডিজাইন উন্নয়নের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার অভিযোগ তোলেন।

এ বিষয়ে জেডিপিসির পরিচালক সীমা বোস জানিয়েছেন, নুপুর খানমকে একবার ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে তাকে পুনরায় সদস্য করা হয়। মেহেদি হাসানের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, সরকারি অর্ডার সবসময় স্বচ্ছতার মধ্যে দেওয়া হয় এবং যথাযথ জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৯১ কোটি ডলার, তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৭৮ কোটি ৪৬ লাখ ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭.৫৩ শতাংশ কম। রপ্তানি কমার কারণ সম্পর্কে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ জানান, এ বিষয়ে তার কাছে নির্দিষ্ট তথ্য নেই।


পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো প্রত্যাশিত ফল দেয়নি। পলিথিনের বিকল্প সোনালী ব্যাগ, পাট পাতার চা, এবং জুটিন (পাটের তৈরি টিন) এখনো বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। বিশেষ করে, জুটিনের দাম বেশি হওয়ায় এটি সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না।

পাটজাত পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিয়ে সরকার নতুন আইন করলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। সচিব জানান, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রয়েছে পলিথিন বন্ধ করতে এবং পাটের মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে।

সর্বোপরি, পাট খাতের উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রশিক্ষণ এবং প্রচারণার অভাবই সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন ও রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।

Tags

- Advertisement -