প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির এক অদৃশ্য নায়ক

প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বর্তমান সময়ে মানুষ উন্নত বেতন, উন্নত জীবনযত্রার জন্য নিজ দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে চলে যান কর্মজীবন শুরু করতে। যার ফলে, বিদেশে কর্মরত এবং বিদেশে বাস করা লোকেরা প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স আয় করে এবং আয় করা রেমিটেন্স নিজ দেশে পাঠায়। যত বেশি লোক বিদেশে বাস করে এবং কাজ করে, তত বেশি রেমিটেন্স দেশের আয় হিসেবে বৃদ্ধি পায়।

প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
২০২০ সালে বাংলাদেশ ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় অর্জনের খাতায় যোগ হয়েছে।। তাতে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ছিল অষ্টম স্থানে, ২০২০ সালে উঠে আসে সপ্তম স্থানে। অপরদিকে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেড়ে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালে প্রবাসীরা বাংলাদেশে প্রায় ২৪.৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৮%। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

রেমিট্যান্স একটি দেশের মাথাপিছু আয় এবং জিডিপির মান উন্নয়ন করে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। দেশের বিপুলসংখ্যক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান ও অর্থোপার্জন পরিবারগুলোর সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রেখে চলছে।রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গড় আয় বৃদ্ধি পায় এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়।

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশের অসচ্ছলতা হ্রাসেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে । বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো অর্থ পরিবারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অর্থ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগে এবং স্বচ্ছলতার জন্য ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, রেমিট্যান্স প্রাপ্ত পরিবারগুলো সচ্ছল হবার পাশাপাশি অন্যান্যদের সামাজিক উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। এভাবে
রেমিটেন্স একটি দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ায় এবং উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ দেয় ,যেমন: অধিকতর উন্নত খাদ্য, উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ইত্যাদি।এভাবে রেমিট্যান্স স্থানীয় অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।

বিগত সরকার বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯ সালে প্রণোদনার ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে প্রবাসীরা বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে ২.৫% হারে নগদ প্রণোদনা পেয়ে থাকেন। এর ফলে প্রবাসীরা হুন্ডির মতো অবৈধ পন্থার পরিবর্তে বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সহজতর করতে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে প্রবাসীদের বৈধভাবে দেশে অর্থ পাঠানোর জন্য নিরাপদ ও দ্রুত ব্যাংকিং ব্যবস্থা উন্নয়ন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ চ্যানেলগুলো যেমন হুন্ডি প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

সরকার প্রবাসীদের আয় বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে ‘ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড’ চালু করেছে। এটি একটি করমুক্ত বন্ড, যেখানে প্রবাসীরা তাদের উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে পারেন। এর মাধ্যমে প্রবাসীদের আয় দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে।
আবার, দেশে ফেরার সময় প্রবাসীরা নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং কিছু ক্ষেত্রে কর রেয়াত সুবিধা পান। যেমন, প্রবাসীদের আনা প্রযুক্তিপণ্য বা গাড়ির উপর শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। এতে তারা যেন বৈধ পথে আয় দেশে পাঠানোর জন্য আরও উৎসাহিত হোন সেজন্যই এ পদক্ষেপ। এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রবাসীদের জন্য সহজ ঋণ এবং বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে, যাতে তারা বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি করতে পারেন।
এছাড়া সরকার রেমিট্যান্স পাঠানোকে আরও দ্রুত এবং সহজ করার লক্ষ্যে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলোকে আরও কার্যকর করছে। বিশেষত মোবাইল ফাইন্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম যেমন বিকাশ, নগদ ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রবাসীরা দ্রুত অর্থ পাঠাতে পারছেন। এই সুবিধাগুলো প্রবাসী আয়ের প্রবাহকে সহজ ও কার্যকর করছে।

নীতিমালা শুধু বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াচ্ছে না, বরং দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে প্রবাসী আয়ের প্রভাবকে শক্তিশালী করছে।

তবে, রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হলেও এর প্রবাহ এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা বিদ্যমান। রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো প্রবাসীদের বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে অবৈধ পন্থা, বিশেষত হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা। যদিও সরকার প্রণোদনা এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করছে, তবুও হুন্ডি এখনও অনেক প্রবাসীর কাছে জনপ্রিয় রয়ে গেছে, কারণ এটি দ্রুত এবং সহজতর বলে বিবেচিত হয়। এর ফলে সরকার বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ায় প্রবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তে স্থিতিশীল বা নিম্নমুখী রয়েছে। যেমন মালয়েশিয়া , ওমান, কাতার সহ অন্যান্য দেশগুলোতে কেবল নির্দিষ্ট সংখ্যক দেশ থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকই যেতে পারে । এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে সেখানে লোক যাওয়ার সংখ্যা সীমিত এবং কেউ বেআইনিভাবে সেখানে প্রবেশ করলে তাদের আটক বা কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিদেশি শ্রমবাজারে নতুন শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ যেমন ভিসা নীতি কঠোর হওয়া, গন্তব্য দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি করে। এই চ্যালেঞ্জগুলো প্রবাসীদের আয়ের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

আবার, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিক কম দক্ষ, যাদের বেতনও তুলনামূলকভাবে কম। কম আয়ের ফলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও কম হয়। উচ্চ বেতনের চাকরির জন্য দক্ষতার অভাব ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় এই সমস্যার রয়েছে যায়।

একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যদিও কিছু সচেতন প্রবাসীদের দেশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে বৈধ পথে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর উল্লেখযোগ্য প্রবণতা রয়েছে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জটিলতা ও বিলম্বের অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে অনেক প্রবাসী দ্রুত সময়ের মধ্যে টাকা পাঠানোর উদ্দেশ্যে অবৈধ চ্যানেলের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এছাড়া, স্থানীয় ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও গ্রাহকসেবা মানের অভাবও রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

অনেক প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে শোষণের শিকার হন এবং তাদের সুরক্ষার অভাব দেখা যায়। তারা ন্যায্য বেতন বা অন্যান্য সুবিধা পান না, আয়ও সীমিত থাকে। এ ধরনের শোষণমূলক পরিস্থিতি প্রবাসীদের আয় পাঠানোর ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সৌদি প্রবাসীরা। সেখানকার নিয়ম কঠোর হওয়া ,পাসপোর্ট নবায়ন না করা , নিয়ম – নীতি ঠিকমতো না মানার কারণে তারা এ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন । এমনকি অন্যান্য দেশেও প্রায়ই প্রবাসীদের হয়রানীর খবর পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সুরক্ষার জন্য নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগের উদাহরণ কমই দেখা যায়। দেখা যায় প্রবাসীরা দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালেও, অনেক সময় তাদের অর্থ সঠিকভাবে বিনিয়োগের সুযোগ পায় না। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি না হওয়া এবং উচ্চ হারে কর বা জটিলতা এই বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। প্রবাসীদের আয় উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না হলে দেশের অর্থনীতিতে তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সীমিত থেকে যায়। রেমিট্যান্সকে দেশের অর্থনীতিতে সঠিকভাবে কাজে না লাগানোর আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহারের অভাব। অনেক ক্ষেত্রে এই অর্থ ব্যক্তিগত খাতে ব্যবহৃত হয়, যেমন ভোগ্যপণ্য কেনা বা জমি কেনা, যা দেশের উৎপাদনশীল খাতে তেমন কোনো অবদান রাখে না। ফলে, রেমিট্যান্স দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধিতে বেশি ব্যবহৃত হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি অবলোকন করে ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বলা যায়, রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যদি এক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গ্রহন করা হয় তবে এর মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ সহজতর হবে, যা প্রবাসীদের জন্য আরও সুবিধাজনক হবে। এছাড়া, সরকারের কার্যকরী নীতিমালাও রেমিট্যান্স প্রবাহের বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

রেমিট্যান্সের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলা যায় যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অদৃশ্য নায়ক। এটি সরাসরি দেশের উন্নয়নের জন্য অবদান রাখে, কিন্তু তা আড়ালেই থেকে যায়। দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা ও সংকটের সময় নায়কের মতো ভূমিকা পালন করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে এটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, রেমিট্যান্সের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের অযথা হয়রানি বন্ধ করে রেমিট্যান্স প্রবাহের পদ্ধতি সহজ করে সরকার এবং সেক্টর সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহের এই সম্ভাবনাকে সর্বাধিক ব্যবহার করা সম্ভব।

Tags

- Advertisement -