বর্তমান বিশ্বে মুদ্রানীতির অবস্থান

মুদ্রা নীতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন এবং বজায় রাখার একটি মৌলিক উপাদান যা একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি মূলত সুদের হার, নগদ সঞ্চয়ের পরিমাণ, এবং অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ওপর প্রভাব ফেলে। মুদ্রা নীতি দুটি প্রধান ধরনের হয়ে থাকে: সংকোচনকারী (restrictive) এবং সম্প্রসারণকারী (expansionary)। সংকোচনকারী নীতি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়, যেখানে সম্প্রসারণকারী নীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

মুদ্রা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও পদক্ষেপগুলি বৈশ্বিক অর্থনীতির মৌলিক দিক নির্দেশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণে দেখা যায়, ফেডারেল রিজার্ভ (Fed) সুদের হার নির্ধারণ এবং ওপেন মার্কেট অপারেশনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য প্রভাব বিস্তার করে থাকে । ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর, Fed সম্প্রসারণকারী নীতি গ্রহণ করে সুদের হার কমিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সমর্থন করার চেষ্টা করেছে। এর ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার লাভ করেছে এবং unemployment rate কমেছে। ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারীর পরেও Fed অতিরিক্ত অর্থনৈতিক প্রণোদনা সরবরাহ করে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করেছে, যদিও এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার কিছুটা বেড়েছে।
জাপানের উদাহরণ আরও কিছুটা ভিন্ন। দীর্ঘমেয়াদী মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা মোকাবেলার জন্য, জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার ন্যূনতম পর্যায়ে রেখেছে এবং ভ্যালু লাভ পেতে নেগেটিভ সুদের হারও প্রয়োগ করেছে। ১৯৯০-এর দশকের ‘লস্ট ডেকেড’ পর, জাপান নানা ধরনের আর্থিক উদ্দীপনা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যেমন- বৃহৎ পরিমাণে অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ এবং জাপানিজ ইয়েনের মূল্য হ্রাস করা। তবে, দীর্ঘমেয়াদী ফলস্বরূপ, দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রাথমিক প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি বরং দেশটি গভীর সংকটে পড়েছে।

ভারতের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে উন্নত। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (RBI) অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য সুদের হার এবং নগদ সঞ্চয়ের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। ২০১৬ সালে নোট বাতিলের পর, RBI সুদের হার কমিয়ে দিয়ে এবং প্রণোদনা প্রদান করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সমর্থন করেছে। এছাড়া, ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে, RBI বেশ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে এবং ঋণ গ্রহীতাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য সুদের হার কমায়, যার ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম কিছুটা পুনরুদ্ধার লাভ করেছে।

বাংলাদেশের মুদ্রা নীতি একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের মুদ্রা নীতি পরিচালনায় সুদের হার এবং নগদ সঞ্চয়ের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিশেষ করে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রসারণকারী নীতি গ্রহণ করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করেছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে এবং বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সমর্থন করতে সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, মুদ্রা নীতির সুফল যেমন উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নত জীবনযাত্রার মানের দিকে ইঙ্গিত করে, পাশাপাশি এর কিছু কুফলও রয়েছে। সম্প্রসারণকারী নীতির মাধ্যমে সুদের হার কমিয়ে দেয়া হলে, ঋণ গ্রহণকারীরা উপকৃত হলেও, ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগের অনুপ্রেরণা হ্রাস হতে পারে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে। ২০২১ সালে, বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ৫% ছাড়িয়ে যায় যা মূলত খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মুদ্রা নীতির সফল বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

বিশ্বব্যাপী মুদ্রা নীতির বিভিন্ন ধরণের প্রভাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মুদ্রা নীতি শুধু একটি দেশের অর্থনীতির ওপর নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলে থাকে । উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ECB) ২০১৫ সালে পরিমাণগত সহজীকরণ (Quantitative Easing) নীতি গ্রহণ করে ইউরোপীয় অর্থনীতির দুর্বলতা মোকাবেলায় চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে, ECB দীর্ঘমেয়াদী সুদের হার কমিয়েছে এবং বাজারে অতিরিক্ত তরলতা প্রদান করেছে। এই পদক্ষেপের ফলে ইউরোপীয় অর্থনীতি কিছুটা পুনরুদ্ধার লাভ করেছে, কিন্তু এর ফলে ইউরোজোন অঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির সমস্যাও দেখা দিয়েছে।

মুদ্রা নীতির সঠিক প্রয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বৈশ্বিক বাজারের পরিবর্তন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলাদেশে, মুদ্রা নীতি প্রয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় যাতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। এই ক্ষেত্রে, বৈশ্বিক এবং স্থানীয় চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে পারলে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে, বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে আমরা আশাবাদী।
মুদ্রা নীতি কোনো দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং এর সফল বাস্তবায়ন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রা নীতির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব এবং একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। বাংলাদেশে, মুদ্রা নীতির সুফল এবং কুফল বিশ্লেষণ করে, সঠিক নীতি গ্রহণ এবং কার্যকরী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন সম্ভব।

Tags

- Advertisement -