বর্তমান ব্যাংকিং লেনদেনের বিপর্যয়

বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাব এখন স্পষ্ট। গত জুলাই মাসে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে এমন স্থবিরতা এসেছে, যা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে লেনদেন কমে যাওয়ার হারই এই অস্থিরতার প্রধান প্রতিফলন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে ব্যাংকিং খাতে লেনদেন কমেছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা, যা ২০ দশমিক ৬৪ শতাংশের এক ধাক্কায় কমে এসেছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপ, যেমন মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ এবং কারফিউ জারি, সরাসরি অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে থমকে দিয়েছে। ১৭ জুলাই রাত থেকে শুরু হওয়া মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ এবং ১৮ জুলাই রাত থেকে ব্রডব্যান্ড সংযোগ বন্ধের মাধ্যমে সারাদেশে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এটি দেশের ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য বিরাট আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। ইন্টারনেট নির্ভর লেনদেন যেমন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে এর প্রভাব গভীরভাবে দেখা গেছে।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন যথাক্রমে ২০ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং ২১ দশমিক ১২ শতাংশ কমেছে, যা শুধু ইন্টারনেট বন্ধের কারণেই হয়নি। বরং কারফিউ এবং সাধারণ ছুটির ফলে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমও সীমিত ছিল। সাধারণ ছুটির কারণে তিনদিন ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের লেনদেন বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেনের বড় একটি অংশ চেকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যেখানে জুলাই মাসে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন কমেছে। এটি শুধু লেনদেন হ্রাসের একটি সংখ্যা নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর অস্থিতিশীলতার গভীরতা বোঝার একটি সূচক। চেকের মাধ্যমে লেনদেনের এই পতন সরাসরি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের স্থবিরতাকে চিহ্নিত করে। সাপ্লাই চেইন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক লেনদেন, সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠছে, ব্যাংকিং খাতের এই সংকট কবে নাগাদ কেটে উঠবে। আন্দোলন দমনের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে যেমন তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুরের নিয়োগের পর ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের চেষ্টা হলেও তারল্য সংকট কাটছে না। বিশেষ করে যে ব্যাংকগুলোতে শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা ছিল, সেখানে গ্রাহকরা ব্যাপক হারে আমানত তুলে নিতে শুরু করেছেন, যা সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিনের বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, এই সংকট কতটা গভীরে পৌঁছেছে। আন্দোলনের আগে তাদের মোবাইল অ্যাপ ‘সিটিটাচ’-এর মাধ্যমে দৈনিক ৯০ হাজার লেনদেন হতো, যা আন্দোলনের সময় একেবারে শূন্যে নেমে আসে। আগস্টের শেষে এসে লেনদেনের পরিমাণ দিনে ৫৫ হাজারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, লেনদেনের পরিমাণ ও মান দুই-ই উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে সেপ্টেম্বর শেষে লেনদেনের হার কিছুটা পুনরুদ্ধার হলেও, এটি স্থায়ী হবে কিনা তা অনিশ্চিত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনও স্পষ্ট নয়। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যাংক খাতে আস্থার অভাব বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। যদিও কিছু ব্যাংক তাদের আমানত সংগ্রহে ভালো করছে, তবুও বৃহত্তর ব্যাংকিং খাতের ওপর এ আস্থাহীনতা কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগতে পারে।

দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে লেনদেনের এই পতন একটি সংকেত যে, একটি দেশের অর্থনীতি এবং এর আর্থিক কাঠামো স্থিতিশীল রাখতে শুধু সরকারি নীতি বা বাজারের আচরণই যথেষ্ট নয়; এর সাথে আর্থিক খাতের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও আস্থার ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষ করে, ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না করা যায়, তবে ব্যাংকিং খাতের ওপর প্রভাব আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এবং এই সংকট কেবল ব্যাংকিং খাতে সীমাবদ্ধ না থেকে অর্থনীতির আরও গভীর স্তরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

Tags

- Advertisement -