বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা

বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশেষত ২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে লকডাউন অবস্থা, ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন ভূখণ্ডে আক্রমণের ফলে সৃষ্ট অস্থির পরিস্থিতি ও সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে চলতে থাকা যুদ্ধাবস্থার ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের প্রতিকূল অবস্থা আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। তবুও বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের অস্থিতিশীলতার কারণে বর্তমানে এ প্রতিকূল অবস্থা আরো ঘনীভূত হতে দেখা যাচ্ছে, যা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি। একটি কার্যকর ও আকর্ষণীয় ব্যবসায়িক পরিবেশ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। যা ব্যবসায়িক আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আবার ২০২১ সালের মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫.৫৬% কিন্তু ২০২৩ সালে তা ৬. ৯২% এ  দাঁড়ায়। যা গত দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.২৫% পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুযায়ী গত জুলাইয়ে এ হার ছিল ৭.৯%। ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জটিল সরকারি নীতিমালা ও কর ব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ।করের উচ্চ হার এবং নীতিগত অসঙ্গতি ব্যবসায়িক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাবে উৎপাদন কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সমস্যা সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এল সি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা সংক্রান্ত জটিলতা ব্যবসায়ীকদের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাম্প্রতিক কালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেন ব্যবসায়িক পরিবেশে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। ফলে ক্ষুদ্র, মাঝারি সহ বড় বড় ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ পড়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে সম্প্রতি কোটা আন্দোলনের কারণে ইন্টারনেট সেবা ও সড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়াকে মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা যায়। এছাড়া রিজার্ভের টালমাটাল অবস্থার কারণে বাণিজ্যিক

 বিধি- নিষেধ ও শেয়ার বাজারের নিম্নমুখী গতির ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ সংকটাপন্ন। বিশেষতঃ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাওয়ার উপক্রম। তাছাড়া শেয়ার বাজারের মন্দা অবস্থার কারণে বড় বড় ব্যবসায়ীরাও লাভের মুখ দেখছেন না।

বর্তমান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করলে , কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে সরকার পতনের আন্দোলন সংক্রান্ত অস্থিতিশীলতার কারণে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়, যার কারণে আমদানি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাত- বিশেষত পোশাক শিল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থলবন্দর বন্ধ থাকার কারণে পোশাক শিল্পের অর্ডার বাতিল হবার সম্ভাবনাও অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনার মুখোমুখি করেছে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয়ের সিংহভাগই আসে পোশাক শিল্প থেকে। ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠা আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোর অবস্থান, কারফিউ জারি, সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা, সরকারি -বেসরকারি অফিস, ব্যাংক বীমা, শেয়ারবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা বন্ধ রাখা ও পরবর্তীতে সরকারের পতনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ- সবমিলিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক অর্থনীতিতে। এছাড়া সে সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মোবাইল ব্যাংকিং, ই কমার্সসহ যোগাযোগের সব ব্যবস্থা বন্ধ রাখার  কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশ। সব মিলিয়ে এই  ক্ষতি প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা বলে ধারনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করলে ক্ষতির পরিমাণ মোট বাজেট ব্যয়ের সাত ভাগের এক অংশের  সমান।

খাত গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, আন্দোলন কে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় প্রতিদিন দেশের ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা, যেখানে শুধু পোশাক শিল্পেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যদিও এক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির চেয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজের ক্ষতির পরিমাণই বেশি।

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, ব্যবসায়ীরা বর্তমানে প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার। সারাংশে; কোটা আন্দোলন ও সরকার পতনের আন্দোলন স্বল্প মেয়াদী অর্থনৈতিক বিঘ্ন এবং ব্যয় বৃদ্ধি ঘটালেও এটি দেশের সামগ্রিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আলোচনা শুরু করেছে। এই সংস্কার গুলো যদি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক কার্যকারিতা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা উন্নত হতে পারে।

এ প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। যেমন বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা ও কাঠামো প্রণয়ন  এবং তা কার্যকর ভাবে বাস্তবায়ন, দ্রুত কার্যকর প্রশাসনিক সেবা প্রদান। এছাড়াও বিদ্যুৎ, পানি, সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা। সাম্প্রতিককালে দেশে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের পরিবর্তন, অবকাঠামোগত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি উক্ত চ্যালেঞ্জকে আরো বাড়িয়ে দেয়। জারি করা কারফিউ এর অচল অবস্থাও অতীতে ব্যবসায়িক পরিবেশে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।

তবে আশার কথা হল, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রথমে দেশের স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতি হওয়া অবকাঠামো মেরামত করতে হবে। বাধ্যবাধকতা দূর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্কুল, অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দিতে হবে। চলমান ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং দেশকে সামগ্রিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে কিছু প্রণাদনা ও দিতে পারে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করে বিদেশি ক্রেতাদের সাথে দেশি ব্যবসায়ীদের যোগাযোগের পথ সুগম ও অব্যাহত রাখা উচিত। এক্ষেত্রে দেশের চলমান অবস্থা যত উন্নত করা যাবে ততই মঙ্গল। শুধু তাই নয়, বাণিজ্য সংক্রান্ত কাঠামো ব্যবসায়ীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। অর্থনৈতিক সংকটের সময় জরুরি সহায়তা এবং পূর্ণাঙ্গ একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ করে প্রশাসনিক জটিলতা কমানো, লাইসেন্স প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক নীতি এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসার জন্য সহজতর ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকারীদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর দেশের উপযোগী নীতি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের ডলার সংকট মোকাবেলায়, মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ, টাকার মান বৃদ্ধি, টাকা পাচার রোধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিশেষ নজর রাখতে হবে। টাকা পাচারকারী, অসৎ ব্যবসায়ী চিহ্নিত ও মোকাবেলা করে সৎ ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক ও  নীতিগতভাবে সাহায্য করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিই মূল উদ্দেশ্য হতে হবে।

বর্তমান বিশ্বের প্রতি আলোকপাত করে বলা যায়, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলির ডিজিটালাইজেশন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ই-কমার্স এবং ই ব্যবসায়িক কার্যক্রম কে উৎসাহিত করতে নীতিগত সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করা উচিত। একটি উন্নত বাংলাদেশ উদ্যোগের আওতায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।

পরিশেষে বলা যায়, এতদিন চলে আসা ব্যবসায়িক মন্দা অবস্থার জন্য পরিস্থিতি ও সংশ্লিষ্ট নীতি কর্মকর্তারা দায়ী হলেও ঘটে যাওয়া কোটা আন্দোলন ও সরকার পতনের দেশে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের পরিবর্তনের কারণে ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা এই ব্যবসায়িক সংকটকে যেন আরো উতরে গেছে দিয়েছে। দেশের শাসন ব্যবস্থায় যারাই আসুক, চলমান অস্থিতিশীলতা মোকাবেলা করে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু, এলসি খোলা সহজীকরণ ও ব্যবসায়িক হয়রানি বন্ধ করে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনি কাঠামোকে তাদের অনুকূল করে তুললেই ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে শেয়ার বাজারের উন্নতি, ডলার সংকট সমাধান ও টাকার মান বৃদ্ধি সহ অতি জরুরী কতক পদক্ষেপের দিকেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তবেই আশা করা যায় ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি হবে। এভাবে একটি কার্যকর ও একটি আকর্ষণীয় ব্যবসায়ী পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইবে বলে আশা করা যায়। যা সাধারণ জনগণ ও অর্থনীতি,সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথ ত্বরান্বিত করবে।

Tags

- Advertisement -