বিচার বিলম্বের কলকাঠি

লেখা-মঈদুল ইসলাম (সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ)

ওকালতিতে নেমে প্রথমেই যেটা লিখি সেটা ছিল ‘টাইম পিটিশন’। আদালতে প্রথম যেটা ‘মুভ’ করি সেটাও ‘টাইম পিটিশন’। একদিন এক সহ-জুনিয়র তার চিরকুট দেখিয়ে জানালেন, তাকে মুভ করতে পাঠানো হয়েছে শুধু মামলাগুলোর নম্বর দিয়েই। কোন পক্ষে সময় চান আদালত জানতে চাইলে কী জবাব দেবেন! হাতে হাতে মোবাইল ফোন দূরে থাক, ঘরে ঘরে টেলিফোনই তখন হয়নি, জায়গায় বসে জেনে নেয়ার কায়দা নেই। বললাম: বলবেন, হুজুর, নিরপেক্ষ! তখন ১৯৮৫ সাল। আদালত ভেঙে ছড়িয়েছে উন্নীত জেলা-উপজেলায়। মামলাও গেছে চলে। বিষণ্ণ সিনিয়ররা ভাঙা সেরেস্তায় জুনিয়র রাখতে রাজি নন। দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঠাঁই পেয়েছিলাম এক সদাশয়ের কাছে। এহেন অবস্থায়ও টাইম পিটিশনের কমতি নাই।

কিন্তু প্রশ্ন, কোন ধারায়? মিলছে নাকো জবাব তার। আমার কোনোমতে পাসের সিলেবাসে তো ছিলই না। ভালোমতো পাস দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম (জনে জনে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, নিজের ফাঁকি ফাঁক হয়ে পড়ে!)। তাদেরও অজানা, সিলেবাসে ছিল না। পুঁথি ঘেঁটে পাওয়া গেল ‘সিপিসি’ (দেওয়ানি কার্যবিধি)-এর ১৪৮ ধারার ‘এনলার্জমেন্ট অব টাইম’, আর ‘সিআরপিসি’ (ফৌজদারি কার্যবিধি)-এর ৩৪৪ ধারার ‘পোস্টপন অর অ্যাডজর্ন প্রসিডিং’! আজব ব্যবস্থা শিক্ষায়! ‘রেসজুডিকাটা’, ‘রেস-সাব- জুডিস’ তত্ত্ব মুখস্থ করায়। কর্মক্ষেত্রে প্রথম দিন থেকে বাকিটা জীবন নিত্যই লাগে যে বিদ্যা তা হাতে দেয় না, রাখে কলমেই!

‘মতলবিবিদ্যা’ বিদ্যালয়ের সবকে নয়, পাওয়া যায় কর্মক্ষেত্রের সহবতেই। সময়ের বাঁধনে ন্যায়বিচারের পথ যেন দৈবেরও পাকে না আটকায় ব্রিটিশ তাই এ দুটি ধারায় ‘ডিসক্রিশন’-এর প্রেসক্রিপশন দিয়ে গেছে আদালতের হাতে। প্র্যাকটিসে তা বুমেরাং বনেছে, মোক্ষম অস্ত্র ন্যায়বিচারের গতি রুখতে। হবার কথা দৈবাৎ, হয় অহরহ। সাক্ষী আসেনি, মক্কেল আসেনি, সবার ওপরে ‘লইয়ার্স গ্রাউন্ড’ ব্যস্ত অন্য গ্রাউন্ডে। বিপক্ষের আপত্তি করতে নেই। বিচারকের আর উপায় থাকে! তারও নিজস্ব গ্রাউন্ড আছে। হাজারো মামলা তার। আসল ব্যস্ত কোনটাতে তার নম্বরটাও লেখেন না অনেকে। একটা দিন গেলে তারিখ পড়ে ৪ মাস পর, তিনটাতে বছর পার। বিচারের সময় গড়ায় সময় দেয়া-নেয়াতে। মামলার নথি মোটা হয় ‘টাইম পিটিশন’ আর হাজিরাতে।

‘ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস’-এর খাতির পেয়ে অ্যামেরিকান এক প্রসিকিউটরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের আদালতে ‘টাইম পিটিশন’ কেমন চলে! মাথায়ই ঢোকে না তার। শেষে বলে, জজ সাহেব স্বয়ং অসুস্থ না হলে কোনো মামলায় দিন মার যায় না, তারিখ পাল্টায় না। ‘টাইম পিটিশন’ খাটে না সেখানে। আমাদের এখানে সময় যারা চান তারা পাওয়াটা অধিকার জ্ঞান করেন। দেবার দায়িত্ব যাদের তারা দিয়ে দায় সারেন। চাহিবামাত্র দিতে অবাধ্য হলে দুঃসময় নামতে পারে সেই বিচারকের। বয়কটে পড়তে পারেন। অনাস্থা জানিয়ে মামলা বদলির দরখাস্ত দেবার জন্য সময় চাইবে। মামলা বদলির দরখাস্তে যা নয় তাও বদনামি থাকতে পারে। অবমাননা হয় না অধস্তনের! জজিয়তির কাঁচাবয়সে এমন একখানা দরখাস্তের বিবরণ আদালত অবমাননাকর বলে হাইকোর্টে জানিয়ে ফল বুঝেছি ইশারাতে, জবাবটাও না আসাতে। মামলা আটকাবে বদলির দরখাস্তে।

বিচারের মাঝপথে আদেশের বিরুদ্ধে আপিল-রিভিশনে যাবেন, সময় দেন। হার-জিতে নাহি ধার, যেতে পারলেই অনন্তকাল! কবে ফিরবে নিজেও জানে না। হাইকোর্ট বিভাগে শুনানির তালিকায় এগিয়ে আসতে না আসতেই বেঞ্চ ভেঙে নতুন বেঞ্চ। মামলা নামবে তালিকার তলানিতে। সাপ-লুডু খেলায় যেমন ঘটে। আছে টাইম পিটিশন, লইয়ার’স গ্রাউন্ড, আদালতের গ্রাউন্ড। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সেইকালে বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে টাইম পিটিশন নামঞ্জুর হলে নাকি মুন্সেফ কোর্ট বলে ব্যঙ্গ করা হতো [৪৭ ডিএলআর (জার্নাল) পৃষ্ঠা-৩৭]। মুন্সেফ পদবিই গেছে পাল্টে। এখন আর বলার কিছু আছে! ব্রিটিশ বেহুদা-উদার ব্যবস্থা দিয়ে গেছে! যৌক্তিক প্রয়োজনে সময় বাড়ানো, ন্যায়বিচারচ্যুতি ঠেকাতে পদে পদে বিস্তর সুযোগ আপিল- রিভিশনের। দেওয়ানিতে খারিজ আর একতরফার পর আবার চালু করার ‘ছানি মামলা’। উদারতার আদত দুর্বলতা প্রমাণ করেছি আমরা সন্তা অজুহাতে সময় কাটিয়ে, আপিল-রিভিশন চালিয়ে। যেখানে আপিল-রিভিশন চলে না সেখানে রিট চালাই নির্বিকারে। এসব হবার কথা কদাচিৎ, হয় নিত্যনৈমিত্তিক। মেকলে সাহেব কিছু বাঙালির চরিত্রে “large promises (প্রতিশ্রুতির পাহাড়), smooth excuses (অনায়াস অজুহাত), elaborate tissues of circumstantial falsehood (দরকারমতো মিথ্যাচারের বিস্তীর্ণ জাল)” তো দেখতে পাবেনই! সাহেব তো আর মাঠ-ঘাটের বাঙালির সাথে মেশেননি।

ব্রিটিশ সময়সীমা বেঁধে যায়নি। ছেড়ে গেছে বিচারকের সদ্বিবেচনা আর আইনজীবীর সদ্ব্যবহারের ওপরে, ধরে-বেঁধে ন্যায়বিচার হয় না বলে। এখন দেওয়ানি-ফৌজদারির প্রায় ধাপেই সময়সীমা বাঁধা। সেই সীমা পেরুলে মামলায় কী হবে সেই পরিণতি বাতলানো নেই বলে হয়ে গেছে ঐচ্ছিক, অনাবশ্যিক। পরিণতি দেয়া হয়েছিল বটে ১৯৮২ সালে সামরিক ফরমানে [ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭(৫) ও ৩৩৯সি (৪) ধারায়! ৬০ দিনে তদন্ত, আর ৩০ দিনে ম্যাজিস্ট্রেটের ও ৬০ দিনে দায়রার বিচার শেষ না হলেই আসামি খালাস। দারুণ পরিণতি! সবারই পোয়াবারো, বিচারেরও বারোটা। সময়গুলো কিছু বেড়েছিল পরে, খালাস হলে আবারও তদন্ত-বিচারে আনার কায়দা লাগিয়ে (১৬৭ (৭এ) ও ৩৩৯ডি ধারায় করে নিদারুণ পরিণতি। ১৯৯২ সালে গণতন্ত্রের সুবাতাসে সেসব গেছে উড়ে। তদন্ত আর বিচারের সময় হয়েছে বাঁধনহারা। এখন প্রায় আইনেই সময় বাঁধে ফসকা গেরোয়। বাঁধা সময় ফুরালে সুপ্রিম কোর্টকে, সরকারকে জানিয়ে আদালত সময় বাড়িয়ে নেবে নিজেই। বজ্র-আঁটুনির ফাঁসও আছে দুয়েকটিতে। নির্ধারিত কম সময়ে (৯০+৩০+১৫ দিন) নিষ্পত্তির জন্য মামলা উঠিয়ে আনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে, তার মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে মামলা ফেরত ধীর বিচারের আগের আদালতে (ধারা ১০ (৪)]। মামলারই তো দোষ! অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ টাইব্যুনালে নির্ধারিত কম সময়ে (৩০০+৬০+৩০ দিন) নিষ্পত্তি না হলে মামলা থাকে বসে, জানাতে হয় সরকারকে। সময় বাড়াবে সরকার [ধারা ১০ (৭ক)]। শুধু জানলেই চলবে! এসব করেই ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মামলা জমেছে প্রায় ৩৭ লাখ। দেওয়ানিতে ১৫ লাখ, ফৌজদারিতে ২১ লাখ, আর লাখখানেক অন্যান্য। বিচারকপ্রতি ভার বেড়েছে উপরে বেশি। বিচারকপ্রতি মামলা আপিল বিভাগে ৩৯৩৬টি, হাইকোর্ট বিভাগে ৫০৪১টি, অধস্তনে ১৭৫০টি। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৯ সালের রিপোর্ট বিশ্লেষণে এসব খবর বেরেয়িছে। প্রতিবছর নিষ্পত্তির চেয়ে দাখিল বেশি। প্রতিবছর মামলা জমছে বেসামাল হারে। ‘giz’, ‘ukaid’, `german cooperation’-এর সহযোগিতায় আইন মন্ত্রণালয়ের করা ‘জাস্টিস অডিট বাংলাদেশ ২০১৮’-তে এসেছে ফৌজদারিতে গড়ে প্রতিবছর নিষ্পত্তি মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। তারা শুধু ফৌজদারিই দেখেছে। বিদেশিদের নজর শুধুই আমাদের কারাগারের দিকে! দেওয়ানির দুঃখ ঘুচাবার কেউ নেই। দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য স্পেশাল জজ আদালত, দ্রুত বিচার আদালত, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, অর্থ ঋণ আদালত করা হয়। জট লেগেছে সেগুলোতেও। এখন আরও দ্রুততম বিচারের আদালত চাওয়া হচ্ছে। এক জেলায় নকলখানার ‘জাজ-ইন-চার্জ’-এর দায়িত্ব পেয়ে দেখি নকলের ‘স্পেশাল-আর্জেন্ট’ সিস্টেম চালু হয়ে আছে। ‘অর্ডিনারি’, আর ‘আর্জেন্ট’ আছে বিধিতে। অর্ডিনারিতে জট লাগিয়ে আর্জেন্টে আটকে গিয়ে ‘স্পেশাল-আর্জেন্ট’ বের করেছে বিশেষ বুদ্ধিতে। দ্রুত হয়নি তাতে।

হুজ্জতে আমাদের নাকি “আদালতে যাওয়া হাঁসের পুকুরে যাওয়ার মতো” (সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আইন-অধিকার ও বিরোধ মীমাংসা, পৃষ্ঠা ১৭)। পরিসংখ্যানমতে আদালতে যায় আমাদের মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ। যাদের ৫০ শতাংশ মামলাই ভুল-মিথ্যা-অচল। তাহলে ওই হাঁসেরা আছে এই ১৩ শতাংশেই। বেশিটা তারা নিজেরাই, আর বাকিদেরও তারাই এনেছে কলে ফেলে। জাস্টিস অডিট বাংলাদেশ ২০১৮-তে বিচার পাওয়ার নিশ্চিত ভরসা জানিয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ, বাকিদের ভরসা কারও ক্ষীণ, কারও শূন্য। ভরসাহীনতার বড় কারণ বিচারের গতিহীনতা, তার মূলে সময় দেয়া-নেয়া।

মামলা বাধিয়ে সময় কাটায় সে যার নিশ্চিত পরাজয় নিষ্পত্তিতে। বিচার- নিষ্পত্তি বিলম্বিত রেখে বিপক্ষকে কায়দায় ফেলে নায্য পাওনা ছেড়ে অন্যায় আবদারের সাথে আপসে আসতে, নয়তো পালিয়ে বাঁচতে। ন্যায্য হকদার সময় ঠেলে মরে। সময়মতো বিচার দিতে নিরুপায় আদালতের আপসের উৎসাহ পেলে কার ইচ্ছাপূরণ হয়। মামলার জট লেগেছে মতলববাজদের কায়দাতে, ফায়দাও তুলছে তারা। নিশ্চিত জানে কাউকে মামলায় ঢুকিয়ে দিলে পাহাড় ঠেলে বেরুবার পথ পাবে না ইহকালে। আসতে হবে তাদের কলে। চলে তাই মিথ্যা মামলা। থানায় যদি নেয়ানো না যায় তো অনায়াসে ঢুকে যায় আদালতে। এখন আবার উদ্ভাবন করেছে ভুয়া ওয়ারেন্ট লাগিয়ে আসল মামলার কায়দা, একজনের ভুয়া পরিচয়ে অজ্ঞাতজনের মামলা করা। পূর্ণ আস্থা তাদের, মামলাজটে তাদের ধরার সময় হবে না কারও। আদালতকে যেন অভয়াশ্রয়, পরম প্রশ্রয়ের ঠাঁই পেয়েছে এই মতলববাজ, ভুয়াবাজ দুর্বৃত্তরা।

আদালতে মামলা ঢোকে না আইনজীবী ছাড়া, এক মুহূর্তও মামলা চলে না আদালতের আদেশ বিনা। অনেকের মতে-এই যে ৩৭ লাখের জট, অর্ধেক তার লাগায়েছে আইনজীবী অর্ধেক আদালত। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কথা, “লোকে আইনজ্ঞদের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে বিরক্ত হয়ে বলতে শুরু করে, আইনের শাসন নয় তো আইনজীবীদের শাসন।” (আইন- অধিকার ও বিরোধ মীমাংসা, পৃষ্ঠা ৮২) ‘পাবলিকের’ এই বিরক্তি, কটূক্তি কাটাতে হবে আইনজীবী আর আদালতকেই। মতলববাজদের কলকাঠি থেকে ন্যায়বিচারের গতি উঠিয়ে আনতে হবে। খোদা না করুন, কালের গতিকে নিজেরা মামলার পাঁকে পড়ে গেলে দিশা হারাতে হবে। চিকিৎসা-হাসপাতাল- ওষুধ কারবারিরা নিজেদের রোগ বিদেশ থেকে সারিয়ে আনতে পারে। বিচারী, আইনের কারবারি, প্রশাসনের দণ্ডধারী কারও নিজের মামলা আন্তর্জাতিক আদালত থেকে নিষ্পত্তি করিয়ে আনার ব্যবস্থা কি আছে!

Tags

- Advertisement -