বিপ্লবী চিন্তার এক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

জন্মিলে মরিতে হয়,
আকাশে প্রস্তর নিক্ষেপ করিলে,
তাহাকে ভূমিতে পড়িতে হয়,
খুন করিলে ফাঁসিতে যাইতে হয়,
চুরি করিলে কারাগারে যাইতে হয়,
তেমন ভালোবাসিলে কাঁদিতে হয়—-
অপরাপরের মতো ইহাও একটি জগতের নিয়ম।

 

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু প্রতিভাবান লেখক রয়েছেন, যাঁদের রচনা শুধু সাহিত্যজগৎই নয়, সমাজের মূল স্রোতকেও প্রভাবিত করেছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই বিরল প্রতিভার একজন। তাঁর রচনা বাংলা সাহিত্যের একটি অমলিন অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে সমাজের প্রতি গভীর উপলব্ধি, অসংখ্য মানবিক অভিজ্ঞতা এবং একটি অবিচল শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রতিবেদনে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম, তাঁর সৃষ্টির প্রভাব এবং তাঁর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবদানের বিষয়ে।

শরৎচন্দ্রের জীবন ও শৈশব-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, নদীয়া জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তাঁর পিতা দয়ালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন সাধারণ শিক্ষক, আর মাতা কন্যা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই শরৎচন্দ্রের মধ্যে সাহিত্য প্রেম ও মানবিকতা পরিস্ফুট হয়েছিল। তাঁর শৈশব ও কৈশোরের অভিজ্ঞতা এবং গ্রামীণ জীবন তাঁকে সাহিত্যকর্মের জন্য প্রচুর উপাদান দিয়েছিল। গ্রামের অভাব-অনটন, সমাজের অগ্রগতির সমস্যা এবং মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম তাঁকে এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছিল যা পরবর্তীতে তাঁর রচনাবলীতে প্রতিফলিত হয়েছে।

সাহিত্যিক জীবন ও প্রথম কাহিনী
শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় ১৮৯৫ সালে। তখন তাঁর প্রথম ছোট গল্প “মহেশ” প্রকাশিত হয়। যদিও এই প্রথম কাজটি তাঁর লেখক সত্তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটায়নি, তবে এটি তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা পর্ব ছিল। এরপর তিনি কাহিনী লেখায় মনোনিবেশ করেন এবং তাঁর রচনাবলী দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। তাঁর প্রধান কাজগুলোর মধ্যে “দেবদাস”, “চরণদাস চবিওয়ালা”, “স্বামী”, “পল্লীকৃষ্ণ”, “রানী”, “বৃহন্নলা” প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।

“দেবদাস”: প্রেমের অমর কাহিনী-
“দেবদাস” শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা, যা বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কাহিনীটি দেবদাস নামক এক যুবকের প্রেম এবং হতাশার কাহিনী। দেবদাসের প্রেমিকা চন্দ্রমুখী এবং পার্বতী—এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে শরৎচন্দ্র প্রেম, দ্বন্দ্ব ও সামাজিক বাধার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। দেবদাসের দুঃখ ও অসহায়ত্বের মাধ্যমে তিনি প্রেমের অমরত্ব এবং সামাজিক বাধার বিষয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। এই কাহিনীটির সৃজনশীলতা ও মানবিকতা এখনও পাঠকদের মনে গভীর ছাপ রেখে গেছে।

পৃথিবীতে কোন সংস্কারই কখনও দল বেঁধে হয় না! একাকীই দাঁড়াতে হয়। এর দুঃখ আছে। কিন্তু এই স্বেচ্ছাকৃত একাকীত্বের দুঃখ, একদিন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বহুর কল্যাণকর হয়। মেয়েকে যে মানুষ বলে নেয়, কেবল মেয়ে বলে, দায় বলে, ভার বলে নেয় না, সে-ই কেবল এর দুঃখ বইতে পারে, অপরে পারে না। আর কেবল নেওয়াই নয়, মেয়েমানুষকে মানুষ করার ভারও তারই উপরে এবং এইখানেই পিতৃত্বের সত্যকার গৌরব।

=স্বরাজ সাধনায় নারী=


সামাজিক প্রতিচ্ছবি: শরৎচন্দ্রের বাস্তবতার চিত্র-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা শুধু ব্যক্তিগত কাহিনীগুলি নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতার একটি সুষ্ঠু প্রতিচ্ছবি। তাঁর “পল্লীকৃষ্ণ” গ্রন্থে গ্রামের কৃষকের জীবনযাত্রা এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা সমস্যার একটি বিশ্লেষণ রয়েছে। গ্রামীণ জীবনযাত্রার বিবরণ, কৃষকের লাঞ্ছনা এবং তাঁর সংগ্রামের কাহিনী আমাদের সমাজের আসল চিত্র তুলে ধরেছে। “চরণদাস চবিওয়ালা” তাঁর একটি সমাজবিরোধী চরিত্রের কাহিনী যা সমাজের দায়িত্বশীলদের অপরাধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছে।

নারীর অবস্থান: আধুনিকতা ও বিপ্লব-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারীর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর “স্বামী” উপন্যাসে, নারীর সামাজিক অবস্থান এবং পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং নারীর জীবনযাত্রার সঠিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। “রানী” গ্রন্থে একটি নারীর আত্মসামাজিক সংগ্রামের কাহিনী উঠে এসেছে, যা নারীর শক্তি এবং মর্যাদার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে।

সামাজিক সংস্কার ও মৌলিকতা –
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমাজ সংস্কারের জন্যও পরিচিত। তাঁর লেখা মানুষের জীবনের মৌলিক সত্যগুলোকে তুলে ধরে, এবং সামাজিক অবিচার ও অনাচারকে অমোঘভাবে আক্রমণ করেছে। “বৃহন্নলা” নামক উপন্যাসে তিনি সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যকার মিথ্যাচার ও অস্বচ্ছলতা তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখার মাধ্যমে তিনি সমাজের দায়িত্বশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি সতর্ক করেছেন।

প্রভাব ও উত্তরাধিকার-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য শুধু বাংলা সাহিত্যেরই একটি অমর অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে পরিগণিত হয়। তাঁর কাজের মাধ্যমে বাংলার সাহিত্যের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের কাহিনীগুলি সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর চরিত্রগুলি পাঠকদের মনে একটি চিরস্থায়ী প্রভাব তৈরি করেছে এবং আজও সেগুলি সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক অবদান শুধু তাঁর সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বাংলার সাংস্কৃতিক পরিসরে অবস্থিত। তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি একটি সামগ্রিক মানবিকতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন যা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
বিপ্লবী চিন্তার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্য যে ধারা তৈরির চেষ্টা করেছে, তা বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন দিগন্ত দেখিয়েছে। তাঁর রচনাবলী মানুষের হৃদয়ে চিরকাল টিকে থাকবে এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্টি ও প্রভাব বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির একটি অমূল্য রত্ন যা আমরা আজও গর্বের সাথে স্মরণ করি।

Tags

- Advertisement -