বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতি

গত কয়েক মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাগত অবনতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দেশের মুদ্রা রিজার্ভকে সুরক্ষিত রাখার একটি প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন এই কৌশল শুধু রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রির চাপ কমাতেই সহায়তা করেনি, বরং আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে আরও কার্যকর করেছে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।

একসময় মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রির মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা কেনার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে কাজ করছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে (এফওয়াই ‘২৪) বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবেলায় $১২.৮০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল, যার বিপরীতে বাজার থেকে $৩.৩৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল। এই সময়কালে মাসিক গড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেট ডলার বিক্রি ছিল প্রায় $৮০০ মিলিয়ন।

তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরুর পরপরই এই প্রবণতায় পরিবর্তন দেখা দেয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক $৬৭৮ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করলেও $১০৫ মিলিয়ন ডলার কিনেছিল। এর ফলে নেট বিক্রি কমে $৫৭৩ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

আগস্ট মাসে এই সংখ্যা আরও কমে আসে। এ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক $১৭০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে এবং মাত্র $১০ মিলিয়ন ডলার কেনে, ফলে নেট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় $১৬০ মিলিয়ন। সেপ্টেম্বর মাসে এটি আরও হ্রাস পেয়ে মাত্র $২২.৫০ মিলিয়নে পৌঁছায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, জানান, ডলারের নেট বিক্রির এই উল্লেখযোগ্য হ্রাস নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শুরু হয়। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের অধীনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. মনসুর দেশের অর্থনীতিতে চলমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি বড় সিদ্ধান্ত নেন।

এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি না করে বাজার থেকে আরও বেশি ডলার কেনার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার জানান, “সেপ্টেম্বর মাসের কেনাবেচার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক $১১১ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করলেও $৮৮.৫০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে, ফলে নেট বিক্রি মাত্র $২২.৫০ মিলিয়ন হয়েছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এবং এটি আরও আগেই করা উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়।”

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এই নীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ডলার বিক্রি বন্ধ করা মূলত আন্তঃব্যাংক বাজারকে সক্রিয় করতে সহায়তা করছে। আমি মনে করি, এই নীতি চালিয়ে যাওয়া উচিত, যাতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা আসে।”

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন বৈদেশিক মুদ্রা কিনছে, তখন বাজার থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে। এটি বর্তমান ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট মোকাবেলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার নেট বিক্রি কমে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় মুদ্রাগুলো ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে রয়ে যাচ্ছে।

মারুফ আরও বলেন, “তহবিলের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আর্থিক নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নীতি প্রয়োগের ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট ততটা চাপ সৃষ্টি করবে না, যেটা আগে বাজার থেকে বের হয়ে যেত।”

বাংলাদেশের পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. এম মাসরুর রিয়াজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নীতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং রিজার্ভ শক্তিশালী করতে এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ। এটি আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। এখন বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও বাজারনির্ভর হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Tags

- Advertisement -