বৈশিক সম্পদের সংকট ও আমাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন

বৈশ্বিক সম্পদের সংকট আজকের পৃথিবীর অন্যতম গুরুতর সমস্যা। মানবসভ্যতার ইতিহাসে আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ, মানব সম্পদ এবং অর্থনৈতিক সম্পদের সংকট মিলিত হয়ে ভবিষ্যতের দিকে এক অনিশ্চিত দিকনির্দেশনা দেখাচ্ছে। এই সংকটের শিকড় যেমন আধুনিক সভ্যতার ক্রমবর্ধমান চাহিদায় নিহিত, তেমনি এটি আমাদের অতিরিক্ত ভোগবিলাস ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার ফল। অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, এবং জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতার মতো বিষয়গুলো শুধু সম্পদের সংকটকেই প্রকট করছে না, বরং এ সংকটের ফলে আমাদের সামগ্রিক ভবিষ্যতও এক বড় ধরণের বিপন্নতার সম্মুখীন।

বিশ্বব্যাপী সম্পদের অপ্রতুলতা বা সংকটের প্রভাব কেবলমাত্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ নয়। উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় ধরনের দেশই এই সংকটের মধ্যে আটকে পড়েছে। আজকের বিশ্বায়নের যুগে প্রতিটি দেশ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং তাই একটি অঞ্চলের সম্পদ সংকট বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের তেল নির্ভরতা এবং বিশ্ববাজারে তার প্রভাব আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমরা জানি, তেল এবং অন্যান্য জ্বালানির ওপর আধুনিক সভ্যতার অনেক বড় ভিত্তি নির্মিত, এবং এই সম্পদগুলির সংকট হলে তার সরাসরি প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পড়ে।

তবে শুধু তেল নয়, আমাদের পানি, খাদ্য এবং বায়ু সম্পদও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার কারণে মাটির উর্বরতা হারাচ্ছে, জলাশয়গুলো ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে, এবং বায়ু দূষণের কারণে মানব স্বাস্থ্যের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য যে মাত্রায় প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, তা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে।

এই সংকট শুধুমাত্র প্রকৃতি বা সম্পদসংশ্লিষ্ট নয়, এটি মানব সমাজের সামগ্রিক চিত্রকে প্রতিফলিত করছে। সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য দিন দিন প্রকট হচ্ছে এবং এ বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক এবং শিক্ষাগত বৈষম্যও বাড়ছে। বিশ্বের অল্প সংখ্যক মানুষ বিপুল সম্পদ অধিকার করে নিয়েছে, এবং এই অসম সম্পদ বন্টনই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটকে জটিলতর করে তুলছে।

বৈশ্বিক সম্পদের সংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমাদের অতিরিক্ত ভোগবিলাস ও অপচয়প্রবণতা। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ‘একবার ব্যবহারযোগ্য’ জিনিসের প্রতি ঝোঁক বেড়ে চলেছে, যা একদিকে সম্পদ অপচয় করছে, অন্যদিকে পরিবেশকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বৈশ্বিক সম্পদের সংকটের ফলে আমরা যে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি, তা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক সংকট নয় বরং এটি সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধেরও সংকট। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশ্বের যেসব অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত, সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা কেবল কঠিন হচ্ছে না, বরং তাদের জন্য ভবিষ্যৎটাও ধোঁয়াশার মতো হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে জীবনযাপন করতে গিয়ে এই মানুষগুলো প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। খাদ্যের সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব, স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা—এই সমস্যাগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।

অন্যদিকে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে সম্পদের অপচয় এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ তৈরি করছে। এই অঞ্চলগুলোতে অত্যাধিক ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা শুধুমাত্র পরিবেশগত ভারসাম্যকেই বিঘ্নিত করছে না বরং সামাজিক মূল্যবোধগুলোকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আজকের দিনগুলোতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে অবহেলা করে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের জন্য অবিরামভাবে প্রকৃতির ক্ষতি করা হচ্ছে। বনভূমি উজাড় হচ্ছে, নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে যে বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকট তৈরি হচ্ছে, তা অচিরেই আমাদের সকলের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনবে।

সম্পদের সংকটের এই বাস্তবতা আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার প্রতিও এক বড় প্রশ্ন চিহ্ন এঁকে দেয়। আমরা কি শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ দেখছি, নাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করছি? আজকের ভোগবাদী সমাজে মানবতার চর্চা কতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে? সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের যে নৈতিকতা, তা কি আমরা মেনে চলছি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, সম্পদের সংকট শুধু মাত্র প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক সংকট নয়, এটি মানবতার সংকটও বটে।

এ সংকটের অন্যতম প্রধান প্রতিফলন হচ্ছে অভিবাসন সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমানভাবে মানুষ তাদের বসতি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চল থেকে মানুষরা জীবিকার তাগিদে ভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে, আর এই অভিবাসন প্রবাহ কেবল বৈশ্বিক জনসংখ্যার ভারসাম্যকেই প্রভাবিত করছে না বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংঘাত। বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে সীমান্ত সংকট, শরণার্থী সমস্যা এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সম্পদের সংকটের কারণে ধনী-গরীবের বৈষম্য যেমন বাড়ছে, তেমনি জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ অবস্থায়, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন এবং পরিবেশের সুরক্ষার জন্য আহ্বান জানালেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার সফলতা খুবই সীমিত। অর্থনৈতিক লাভের জন্য বিশ্বজুড়ে যে ধরনের কর্মকাণ্ড চলছে, তা সম্পদ ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বৈশ্বিক সম্পদের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে প্রকৃতি, মানুষ এবং অর্থনীতি—এই তিনটি উপাদানকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে। আধুনিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণে যে নিছক লাভকেন্দ্রিক মনোভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সম্পদের অপচয় কমানো, পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিসের ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান এবং সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমেই কেবল এই সংকটের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব।

প্রথমত, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা ও প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সম্পদের মূল্য বোঝাতে হবে এবং তাদের ভোগবাদী মনোভাব পরিবর্তনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একদিকে যেভাবে উন্নত বিশ্ব সম্পদ অপচয়ে লিপ্ত, অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে—এই বৈষম্য দূর করার জন্য ন্যায্য বণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্পদের ব্যাপারে মানুষের মাঝে যে অবহেলা এবং উদাসীনতা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে তাদের অতিরিক্ত শিল্পায়নের কারণে যে পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, তা শুধরাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর উচিত কম কার্বন নিঃসরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে মনোযোগ দেয়া। একইসাথে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করতে হবে, যাতে তারা পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন মডেল গ্রহণ করতে পারে।

তৃতীয়ত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈশ্বিক সম্পদের বৈষম্য দূর করতে হবে। বিশ্বব্যাপী ধনী এবং গরীবের মধ্যে যে বিশাল ফাঁক তৈরি হয়েছে, তা কমানোর জন্য একটি টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নীতি ও আইনকে শক্তিশালী করতে হবে, যা ধনী দেশগুলোর শোষণমূলক আচরণ এবং গরীব দেশগুলোর প্রতি অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতির পরিবর্তন ঘটাবে। একইসঙ্গে, কর্পোরেট সেক্টরগুলোর ওপর একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা আরোপ করতে হবে, যাতে তারা মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারে।

অবশেষে, এই সংকট মোকাবিলার জন্য আমাদের মনোজগতেরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ভোগবিলাসী জীবনযাপন থেকে সরে এসে একটি সংযমী, পরিবেশবান্ধব এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জীবনধারা গড়ে তোলার মাধ্যমেই আমরা বৈশ্বিক সম্পদের সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারি। এই সংকটের সমাধান কোন একক দেশ বা অঞ্চলের উপর নির্ভরশীল নয়; এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক সমাধান। সুতরাং, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ন্যায্য সম্পদ বণ্টন এবং পরিবেশগত নৈতিকতাই আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারে।

আমাদের স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য পৃথিবীর যে মূল্যবান সম্পদ আমরা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি, তার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। তাই, এখনই সময়—সচেতনতার সাথে, সতর্কতার সাথে  মানবিকতার সাথে ও আমাদের সামগ্রিক জীবনযাপনকে পুনর্মূল্যায়ন করার। না হলে, আমাদের ভবিষ্যৎ শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, বরং নৈতিক এবং পরিবেশগতভাবে এক গভীর বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে।

Tags

- Advertisement -