মজুরি সংকটে চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা চা বাগানের এক হাজার ৪০০ শ্রমিকের জীবন বর্তমানে চরম সংকটে। প্রায় তিন মাস ধরে তারা বেতন পাচ্ছেন না, আর এই আর্থিক টানাপোড়েন তাদের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে। দুর্গামনি সাঁওতাল, আট সদস্যের একটি পরিবারের প্রধান, চা বাগানের মজুরির ওপর নির্ভর করেই দিন কাটাতেন। এখন সেই মজুরি বন্ধ হওয়ায় পরিবারটি মানবেতর জীবনযাপন করছে।

“একবেলা পান্তা ভাত খেয়ে দিন কাটছে। এখন এমন হয়েছে, কোনো দোকানদার বাকি দিতে চায় না। লজ্জায় কারও কাছে হাত পাততেও পারি না,” বলছিলেন দুর্গামনি নামের এক শ্রমিক। চা বাগানের অন্যান্য শ্রমিকদের অবস্থাও একই রকম। মঙ্গলী সবর নামের এক শ্রমিক হতাশা প্রকাশ করে জানান, “আমরা নিয়মিত কাজে যাচ্ছি, পাতা তুলছি কিন্তু মজুরি পাচ্ছি না। কেউ এসে বিষয়টির মীমাংসাও করে দিচ্ছে না। সবাই শুধু আশ্বাস দিচ্ছে। আর কত না খেয়ে থাকব!”

বাগানের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার এই চরম বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে গেলে জানা যায়, ফুলতলা চা বাগানটির মালিকপক্ষ দ্য নিউ সিলেট টি এস্টেটস লিমিটেড নানা অজুহাত দেখিয়ে দীর্ঘ ১২ সপ্তাহ ধরে শ্রমিকদের বেতন ও রেশন বন্ধ রেখেছে। বাগান পঞ্চায়েতের সভাপতি রবি বুনারজি বলেন, “মালিকপক্ষ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে মজুরি ও রেশন দেওয়া বন্ধ রেখেছে। এ নিয়ে বারবার যোগাযোগ করেও কোনো ফল পাইনি।”

এই অমানবিক পরিস্থিতি শ্রমিকদের জীবন আরও সংকটাপন্ন করেছে। তারা একদিকে শ্রম দিচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহের জন্য সংগ্রাম করছে। চা শ্রমিকদের আয় বন্ধ হওয়ায় বাজারে বাকি নেয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, পুষ্টির ঘাটতি ও অনাহারে দিন কাটানো শ্রমিকদের জীবনের একমাত্র নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে সচেতন হলেও সমস্যার কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না। ফুলতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম শেলু বলেন, “বাগানের বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। বিষয়টি স্থানীয় ও ঊর্ধ্বতন প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।”

তবে প্রশাসনের এমন উদ্যোগের পরও বাগানের ম্যানেজার বা মালিকপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো সমাধান আসছে না। বাগানের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

বাগানের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হেড ক্লার্ক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, “চা বাগানটি বর্তমানে আর্থিক সংকটে আছে।” তবে শ্রমিকদের এই সংকট কাটানোর জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট উত্তর মেলেনি।

জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন জানিয়েছেন, “পূজার আগেই শ্রমিকদের মজুরি দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।” তবে এই চিঠির কার্যকারিতা বা মজুরি প্রদান কবে থেকে শুরু হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।

এই অবস্থায় শ্রমিকদের জীবনযাপন যে আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চা বাগানগুলোর শ্রমিকদের বেতন ও রেশন বন্ধ রাখার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন, মালিকপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে এই শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরে পান এবং সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারেন।

Tags

- Advertisement -