ময়মনসিংহের চার জেলায় বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭

ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির ফলে নদ-নদীর পানি ক্রমশ বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, বন্যার কারণে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যার কারণে শেরপুর ও নেত্রকোনার ৪২৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে, তবে জামালপুর ও নেত্রকোনায় পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ তথ্য জানানো হয়েছে।

শেরপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভোগাই নদীর নাকুগাঁও পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার, নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৪৮ সেন্টিমিটার এবং চেল্লাখালীতে ২৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া, মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর পানিও বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে। নতুন করে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী এবং দশানী নদীর পানিও বেড়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী নাকিবুজ্জামান খান আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “আজকের মধ্যে সব নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করবে, ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”

তবে, বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢল চলমান থাকায় শেরপুরের ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, শেরপুর সদর এবং নকলা উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নতুন করে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যে, জেলার চারটি পাহাড়ি নদীর উজানের পানি কমতে শুরু করলেও নিচু এলাকাগুলো পানিতে ডুবে গেছে। নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও নকলায় বন্যার পানিতে ডুবে দুই ভাইসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। নালিতাবাড়ী থানার ওসি সানোয়ার হোসেন এই মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।

নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন শামীম জানান, উপজেলা ও জেলা প্রশাসন মিলিতভাবে আট হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করেছে। পাশাপাশি, একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫০টি কম্বলও বিতরণ করা হয়েছে। শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দরের কার্যক্রম বর্তমানে স্থবির হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে অধিকাংশ সড়ক ও আমন ধানের খেত, বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য পাকা ও কাঁচা সড়ক।

শেরপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুকল্প দাস জানিয়েছেন, জেলার ৪০ হাজার হেক্টরের বেশি জমির আমন ধান তলিয়ে গেছে। পানি নামার পর চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে। শুক্রবারের পানি বৃদ্ধির পর থেকে ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। ২৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুরে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এই তিন উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং মোবাইল নেটওয়ার্কে বিঘ্ন ঘটেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, হালুয়াঘাটের পানিবন্দি এলাকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে এবং এসব কেন্দ্রে দেড় সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গতদের মাঝে তিন উপজেলায় ৩০ টন খাদ্য সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে এবং রান্না করা খাবারও সরবরাহ করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর, জিগাতলা, পঞ্চনন্দপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে, ফলে পুরো উপজেলাজুড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে নেত্রকোনার উপদাখালী ও সোমেশ্বরী নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে পূর্বধলা, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দাসহ বেশ কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এই বন্যার ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ধোবাউড়া উপজেলায় ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ধান এবং ফুলপুর ও হালুয়াঘাটে যথাক্রমে ৩ হাজার ৬৩০ ও ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে।

নেত্রকোনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানিয়েছেন, জেলার প্রধান নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত নেত্রকোনার জারিয়া-জাঞ্জাইল পয়েন্টে ২০০ মিলিমিটার এবং দুর্গাপুরে ১৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যার ফলে সোমেশ্বরী ও ধনু নদীর পানি বেড়েছে। কলমাকান্দার বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে, এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় জামালপুর ও নেত্রকোনা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে ময়মনসিংহ ও শেরপুরে পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়ছে, তবে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় পানি কমার সম্ভাবনা থাকলেও জামালপুর ও নেত্রকোনার কিছু নিম্নাঞ্চলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

Tags

- Advertisement -