মাইক্রোসফটকে ছাড়িয়ে প্রযুক্তির নতুন রাজার তকমা পাওয়া এনভিডিয়া

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন টেক জায়ান্টের নতুন নতুন নাম উঠে আসছে। তবুও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে নিজেদের শীর্ষস্থানে স্থাপন করেছে। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগল—এসব নাম বিশ্ববাসীর কাছে খুবই পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে টেক হেভিওয়েট মাইক্রোসফটকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি হয়ে উঠেছে এনভিডিয়া। ১৯৯৩ সালে কম্পিউটার চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনভিডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন তাইওয়ানে জন্ম নেওয়া প্রযুক্তিবিদ জেনসেন হুয়াং। চিপ নির্মাণ ও গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট তৈরির জন্যই মূলত পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি । এখন কোম্পানিটির বাজারমূল্য প্রায় ৩.৩৩৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এনভিডিয়া শুরুর দিকে শুধুমাত্র গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট বা জিপিইউ নির্মাণের কাজ করত। প্রতিষ্ঠাতা জেনসেন হুয়াংয়ের নেতৃত্বে কোম্পানিটি দ্রুত প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে ভিডিও গেমের জন্য উন্নত মানের জিপিইউ তৈরি করে এনভিডিয়া বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করে।তবে, কয়েক দশকের মধ্যে এনভিডিয়া জিপিইউ তৈরির পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডেটা প্রসেসিংয়ের মতো ক্ষেত্রে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এনভিডিয়ার শক্তিশালী জিপিইউ প্রযুক্তি শুধু ভিডিও গেমের চাহিদাই পূরণ করেনি, বরং গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবা, অটোমেশন, এবং শিল্প কারখানায় বিশাল ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।

২০০০-এর দশকে প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং কোম্পানির গেমিং ছাড়াও প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে ব্যবহারের জন্য জিপিইউ’র বিকাশে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করার নির্দেশ দেন। এটি এআইয়ের উত্থানে বেশ কার্যকরী হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৯ সালে, তাদের “জিফোর্স ২৫৬ জিপিইউ ” মুক্তি পায়, যা গ্রাফিক্স কার্ডের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব তৈরি করে। এনভিডিয়া কোম্পানির উন্মোচন করা এই গ্রাফিক্স কার্ড বিশ্বের প্রথম গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট হিসেবে পরিচিত। মূলত গেমিং এবং উন্নত মানের গ্রাফিক্স ডিজাইনের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল। এরপর থেকে এনডিভিয়ার নতুন যুগ শুরু হয়।

বর্তমানে এনভিডিয়ার শীর্ষস্থান অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে তাদের অভাবনীয় সাফল্য। এআইয়ের ক্ষেত্রে দ্রুত ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং বিশ্লেষণ করার জন্য যে বিশেষ ধরনের চিপ প্রয়োজন হয়, তা নির্মাণে এনভিডিয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কোর জিপিইউ এবং বিশেষ ধরনের সেমিকন্ডাক্টর এআই প্রযুক্তির জন্য একটি বড় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। মাইক্রোসফটসহ অন্যান্য বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিও এআই নিয়ে কাজ করছে, তবে এনভিডিয়ার জিপিইউগুলোর বিশেষায়িত বৈশিষ্ট্য তাদেরকে অনেক এগিয়ে রেখেছে।

এনডিভিয়া কোম্পানির মাইক্রোসফটকে পেছনে ফেলার ঘটনা প্রযুক্তি দুনিয়ায় এক যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে শেয়ারবাজারে এনভিডিয়ার বাজারমূল্য মাইক্রোসফটকে ছাড়িয়ে যায়। এর প্রধান কারণ ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চিপ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এনভিডিয়ার অগ্রগতি। এআই চিপের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকায় এনভিডিয়ার শেয়ারমূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এআই-নির্ভর যন্ত্রে ব্যবহৃত চিপকে ‘প্রযুক্তি খাতের নতুন সোনা বা তেল’ বলে অভিহিত করেছেন বিশ্লেষকরা। জুলাই ২০২৪ এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এনভিডিয়া ১৬.৬ বিলিয়ন ডলার নেট মুনাফা অর্জন করেছে। এনভিডিয়ার উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির পেছনে ডেটা সেন্টার ব্যবসা, বিশেষ করে জেনারেটিভ এআই এবং ক্লাউড-ভিত্তিক সেবার অবদান রয়েছে।

মাইক্রোসফটকে ছাড়িয়ে ২০২৩ সালে শেয়ারবাজারে এনভিডিয়ার বাজারমূল্য অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে উল্লেখযোগ্য মুনাফা এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি সংক্রান্ত সাফল্যের কারণে এনভিডিয়া শেয়ার মার্কেটে একটি অসাধারণ অবস্থান ধরে রেখেছে। এনভিডিয়া মূলত জেনারেটিভ এআই এবং ডেটা সেন্টার ব্যবসায় বড় ভূমিকা রাখছে, যা তাদের শেয়ারের মূল্য বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।

তাদের শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে এআই ও জিপিইউ (গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট) প্রযুক্তির চাহিদা বৃদ্ধির ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। কোম্পানিটি তাদের এইচ ১০ চিপ এবং অন্যান্য এআই পণ্যদ্রব্যের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এআই শিল্পের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বড় ধরনের আগ্রহ তৈরি করেছে।

এনভিডিয়ার এই সাফল্যের ফলস্বরূপ তাদের শেয়ারের মূল্য ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং তাদের শেয়ারহোল্ডাররা বিপুল পরিমাণে মুনাফা অর্জন করেছেন। এছাড়াও কোম্পানির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসও বেশ ইতিবাচক।কারণ এআই ও অন্যান্য প্রযুক্তি খাতে তাদের অবদান দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে  । চিপমেকার প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ৩.৫ শতাংশ বেড়ে ১৩৫.৫৮ ডলারে পৌঁছায়। কিছুদিন আগে এনভিডিয়া অ্যাপলকে টপকে বিশ্বের দ্বিতীয় দামি কোম্পানি হয়েছিল। বর্তমানে মাইক্রোসফট এবং অ্যাপলের পরেই এন্ডিভিয়ার স্থান।

এনভিডিয়ার বর্তমান সাফল্য শুধু সাময়িক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের বিস্তার, মেটাভার্সের উত্থান, এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দুনিয়ায় এনভিডিয়ার অংশগ্রহণ কোম্পানিটিকে ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী অবস্থানে রাখবে। এর পাশাপাশি, তারা নতুন নতুন বাজার এবং খাতেও প্রবেশ করার পরিকল্পনা করছে, যা তাদের উন্নয়নের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এনভিডিয়া তাদের উদ্বোধনী পণ্য এবং প্রযুক্তির দিয়ে যে বিপ্লব ঘটিয়েছে  শুধু তা নয় ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে  ও প্রভাব ফেলছে।

এনভিডিয়া এখন শীর্ষে থাকলেও, প্রতিযোগিতা তাদের জন্য থেমে নেই। মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, গুগল এবং অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টরাও এআই ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে। মাইক্রোসফট তাদের ক্লাউড প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এআই ও ডিপ লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করছে। এ ছাড়াও, স্যামসাং ও ইন্টেলের মতো চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও উন্নতমানের প্রসেসর তৈরি করছে, যা এনভিডিয়ার সঙ্গে শক্ত প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারে।

অন্যদিকে, চিপ সরবরাহে বৈশ্বিক সংকট এবং মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবও এনভিডিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে চীনের বাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত হলে এনভিডিয়ার বিক্রয় ও রাজস্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া, গবেষণা ও উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগের কারণে এনভিডিয়াকে ব্যয় নিয়ন্ত্রণেও দক্ষতা দেখাতে হবে।

এনভিডিয়ার প্রভাব শুধু প্রযুক্তির জগতে নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও গবেষণা ক্ষেত্রেও পড়েছে। তাদের সেমিকন্ডাক্টর ও এআই প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখছে। তাদের বৈশ্বিক প্রভাব বেশ কয়েকটি কারণে উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে প্রধান ভূমিকা হিসেবে বলা যায় – গেমিং এ এবং এআই এর মাধ্যমে মেডিকেল সেক্টরে এনভিডিয়া নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেখানে ক্যান্সার নির্ণয় এবং চিকিৎসা গবেষণায় তাদের চিপ ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড কম্পিউটিং, মেটাভার্স ও ভার্চুয়াল রিয়ালিটি এমনকি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্বাভাসেও এনভিডিয়ার জিপিইউ প্রযুক্তির প্রভাব ব্যাপক।

বর্তমানে এনভিডিয়া কেবল একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নয়, গেমিং থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি এবং মেটাভার্সের মতো জটিল প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রগুলোতে তাদের অগ্রগতি বিশ্বকে নতুন যুগের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন খাতে দ্রুত  উন্নতির সম্ভবনা দেখা দিয়েছে।

এনভিডিয়ার মাইক্রোসফটকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি হয়ে ওঠা নিঃসন্দেহে প্রযুক্তি দুনিয়ায় এক বড় মাইলফলক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য উদ্ভাবনী চিপ তৈরি এবং সেই প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মাধ্যমে এনভিডিয়া তার অবস্থান সুরক্ষিত করেছে। যদিও প্রতিযোগিতার ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে উদ্ভাবনের মাধ্যমে এনভিডিয়া প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে বড় ভূমিকা পালন করবে।

Tags

- Advertisement -