মিয়ানমারে সামরিক জান্তার পতনে চীনের ভূমিকা

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের পতন এখন এক অনিবার্য বাস্তবতা। বিভিন্ন জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠী এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের (পিডিএফএস) একের পর এক লজ্জাজনক পরাজয়ের ফলে এই অবস্থান তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে চীনের মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। চীনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বারবার মিয়ানমার সফর করছেন, জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতাদের বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। সবকিছুই এই ইঙ্গিত দেয় যে, চীন মিয়ানমারকে নিজেদের প্রভাববলয়ে রাখতে আগ্রহী।

চীনের আনুষ্ঠানিক নীতি হলো মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। তবে বাস্তবে চীন মিয়ানমারের সংঘাতের সঙ্গে জড়িত দুই পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। চীনের এই কৌশলের মূল কারণ হলো মিয়ানমারে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা। চীনের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবে রাশিয়ার উপস্থিতি এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘে তারা একযোগে জান্তা সরকারকে সুরক্ষা দিচ্ছে। পাশাপাশি চীন, তাদের সীমান্তের আশেপাশে থাকা কয়েকটি জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে চলেছে, যারা দীর্ঘকাল ধরে স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করে আসছে।

দৃশ্যমান অবস্থান থেকে মনে হচ্ছে, বেইজিং একটি এমন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যা জান্তার দুর্বল স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশটিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে, আর প্রান্তীয় অঞ্চলে জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করবে। চীন সম্ভবত এই বন্দোবস্তকে বৈধতা দেওয়ার জন্য একটি নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিতে পারে। জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি করার চেষ্টার মাধ্যমে চীন অস্ত্রবিরতির বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে চাচ্ছে।

মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে তুলে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে, এবং তারা চায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা শুধুমাত্র জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকুক। কিন্তু চীনের মিয়ানমারের ব্যাপারে নেওয়া অবস্থান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতি অসম্মান হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এটি একটি সুপরিচিত বিষয় যে, চীন কৌশলে মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আক্রমণের অনুমোদন দিয়েছে। এই আক্রমণে তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং আরাকান আর্মি অংশগ্রহণ করেছে। চীনের অনুমোদনের কারণ হলো তারা হাইগেং যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে পরবর্তীকালে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তবে, চীন কিছু জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীর ব্যাপারে ভুল ধারণা করেছে। নতুন মিয়ানমারে যদি একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এই গোষ্ঠীগুলো চীনের প্রভাব থেকে মুক্তি চায়।

যদিও চীন যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টায় নিরলস, টিএনএলএ প্রকাশ্যে পিডিএফএসকে সহযোগিতা করছে। পিডিএফএস হচ্ছে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শক্তি ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) এর সশস্ত্র শাখা। চীন আনুষ্ঠানিকভাবে এনইউজির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে দ্বিধাগ্রস্ত, যা সম্ভবত গোষ্ঠীটির সামর্থ্য ও পশ্চিমা প্রভাব নিয়ে তাদের উদ্বেগের কারণে।

এছাড়া, যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম মিয়ানমারের সীমান্তে ঘটে, তবে সেটি বেইজিংয়ের জন্য একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। চীনের অবস্থান এনইউজির জনপ্রিয়তার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে। ঐতিহাসিকভাবে এনইউজি বেশ কিছু জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যেমন কারেন, কারেননি, কাচিন ও চিন রাজ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠী। এদের সম্মিলিতভাবে কেথ্রি সি জোট বলা হয়, যার মধ্যে কাচিনের সঙ্গে চীনের সীমান্ত রয়েছে।

এদিকে, নর্দান শান রাজ্য ল্যান্ডলক হওয়ায় এখানকার জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠী চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বেইজিং নর্দান শান রাজ্যের রাজধানী অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, যা এমএনডিএএর নিয়ন্ত্রণে। এই পরিস্থিতিতে চীন দুই দেশের বাণিজ্যে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, ফলে এই অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠী টিকে থাকার জন্য টোল সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

সম্প্রতি রুইলি সিটি স্টেট সিকিউরিটি কমিশন একটি চিঠিতে জানিয়েছে, টিএনএলএকে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। এই ঘটনা চীনের আরো অসন্তোষের ইঙ্গিত দেয়। মিয়ানমারের সীমান্তে চীন সামরিক মহড়া চালিয়ে নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেছে, যা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে।

চীনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড শান ও কাচিন রাজ্য থেকে সেনা সরিয়ে অন্য রাজ্যের জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনা নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করছে। ফলস্বরূপ, কারেননি রাজ্যের রাজধানী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। এটি মিয়ানমারের বিপ্লবী বাহিনীগুলোর জন্য চীনের জবরদস্তির বিরুদ্ধে একটি পথ খুঁজে বের করার গুরুত্বকে আরো সুস্পষ্ট করে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কাছে মিয়ানমার ভূরাজনৈতিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য, তাইওয়ান বা ইউক্রেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণে মিয়ানমারের বিরোধী শক্তিগুলোকে নিজেদের সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে তারা চীনের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে পারে।

(লেখক- থান এন ওও মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক কর্মী এবং ফ্রি মিয়ানমার অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা)

Tags

- Advertisement -