লেবাননের নতুন যুদ্ধ : ইসরায়েল কি আবারও ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে?

শেষবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যখন লেবাননে প্রবেশ করেছিল, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া মাসব্যাপী যুদ্ধে তারা এক প্রকার ভুলেই যেতে চাইবে। সেই যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যরা তীব্র লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল। হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা তাদের একের পর এক পূর্ব পরিকল্পিত ট্যাঙ্ক কলামের ফাঁদে ফেলে দেয়। এই সংঘর্ষে ইসরায়েলের অন্তত ২০টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং ১২১ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হন। যুদ্ধের ফলাফল মূল্যায়নের জন্য গঠিত উইনোগ্রাদ কমিশন জানায়, ইসরায়েল এক দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু করেছিল, যা সামরিক বিজয় ছাড়াই শেষ হয়।

প্রায় দুই দশক পর, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর মঙ্গলবার, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ঘোষণা করেছে যে তারা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে দক্ষিণ লেবাননে সীমিত আকারে স্থল অভিযান শুরু করেছে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, ইসরায়েলের সৈন্য ও ট্যাঙ্ক মোতায়েন দেখে মনে হচ্ছে, দেশটি লেবাননে একটি দীর্ঘমেয়াদী আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গত সপ্তাহে লেবাননে বোমা হামলার তীব্রতা বেড়ে যায়, ফলে নিহত হন হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহ। এর ফলস্বরূপ, প্রায় ১০ লাখ লেবানিজ তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লক্ষ্য স্পষ্ট: হিজবুল্লাহ যেন আর ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর সরকার সম্ভবত হিজবুল্লাহর শক্তি ও সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করছে। এর ফলে ইসরায়েল আবারও লেবাননে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

ইসরায়েলি সেনাপ্রধান হারজি হালেভি ২০০৬ সালের যুদ্ধ থেকে নেয়া শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আপনারা হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মুখোমুখি হলে তাদের দেখিয়ে দেবেন কীভাবে একজন পেশাদার, অত্যন্ত দক্ষ এবং যুদ্ধ-অভিজ্ঞ বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়।”

৭ম সাঁজোয়া ব্রিগেডের সঙ্গে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের ৯৮তম ডিভিশনের অভিজ্ঞ বিমানবাহিনী সৈন্যদের সমাবেশ করেছে, যারা গাজায় কয়েক মাস ধরে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। এছাড়া, উত্তর কমান্ডের অধীনে থাকা ইউনিটগুলোর রিজার্ভ সৈন্যদেরও সক্রিয় করা হয়েছে।

আল জাজিরার প্রতিরক্ষা সম্পাদক অ্যালেক্স গ্যাটোপোলোস জানিয়েছেন, “ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে তাদের উদ্দেশ্য গুরুত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিতে এলিট ইউনিট পাঠিয়েছে।” যদিও দক্ষিণ লেবাননে মোতায়েন করা সৈন্যরা যুদ্ধ সম্পর্কে অভিজ্ঞ, তারা এখন ক্লান্ত, কারণ তারা এক বছর ধরে গাজায় লড়াই করছে।

২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের হাতে আট সৈন্য নিহত এবং দুই অফিসার অপহৃত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল দ্রুত অভিযান শুরু করেছিল। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। সামরিক অভিযানের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর, ইসরায়েল লেবানন জুড়ে হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগার, গুদাম এবং লঞ্চারগুলো লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। এর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত পেজার এবং ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটে। গত শুক্রবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৩২ বছর ধরে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হন।

তবে বাস্তুচ্যুত ইসরায়েলিদের উত্তরে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক লক্ষ্য এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, হিজবুল্লাহ উত্তরের দিকে কয়েকটি রকেট ছুঁড়লে তা ইসরায়েলি নাগরিকদের ফিরে আসাকে বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। সামরিকভাবে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ কখনোই বন্ধ করেনি হিজবুল্লাহ। গ্যাটোপোলোস বলেন, “যখন আপনি ভাবেন যে আপনার প্রতিপক্ষ আপনাকে প্রতিরোধ করতে পারবে না, তখন আপনি তাদের হালকাভাবে নেন। এই অহংকার বেশ বিপজ্জনক।”

২০০৬ সালের তুলনায় হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি অনেক বেড়েছে। দক্ষিণে তখন মোতায়েন ছিল প্রায় ৫ হাজার হিজবুল্লাহ সৈন্য, যা এখন লাখো যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে। তাদের এলিট রাদওয়ান বাহিনীর যোদ্ধারা দক্ষিণে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং এলাকার প্রতি তাদের স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। এই এলিট বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার।

হিজবুল্লাহর কাছে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল মজুদ রয়েছে। এছাড়াও, ২০১৩ সাল থেকে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শাসনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে তারা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করেছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এখন হিজবুল্লাহর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করতে শক্তিশালী নজরদারি ড্রোন বহরের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু লেবাননের মাটির নিচের যুদ্ধ টানেলগুলো হিজবুল্লাহকে নিজ দেশে সামরিক সুবিধা দিতে পারে। গ্যাটোপোলোস বলেন, “হিজবুল্লাহরও ড্রোন আছে এবং তারা ২০০৬ সালের তুলনায় ইসরায়েলি বাহিনীর গতিবিধি অনেক ভালোভাবে নজরে রাখতে পারে।”

ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো ও সাবেক মার্কিন কূটনীতিক নাবিল খুরী আল-জাজিরাকে বলেন, “সামরিকভাবে ইসরায়েল নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য বেছে নিয়ে কিছু মানুষকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য আরো বিস্তৃত।” তিনি আরও বলেন, “তাদের গাজার জন্য, পশ্চিম তীরের জন্য এবং এখন স্পষ্টভাবে লেবাননের জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা রয়েছে।”

তবে তিনি সতর্ক করে দেন যে, আমি মনে করি না যে, ইসরায়েল লেবাননে কোনো স্বল্পমেয়াদি অভিযান চালাবে। তবে ইসরায়েলিদের জন্য এটি অবশ্যই সহজ হবে না, প্রচণ্ড কঠিন হবে। এবং লেবাননে তারা যে ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে তাতে আইডিএফ না চাইলেও সেখানে দীর্ঘ সময় থাকতে বাধ্য হবে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী শেষ পর্যন্ত হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করার জন্য একটি ‘সীমিত’ অভিযান চালানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যদিও হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করার চেষ্টা বারবার করেও ব্যর্থ হয়েছে।

বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার মতো রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে একটি বাফার জোন তৈরি করার কথা বিবেচনা করছে। তবে গ্যাটোপোলোস মনে করিয়ে দেন ২০০০ সালে শেষ হওয়া দীর্ঘ দখলের কথা। তিনি বলেন, “যদি আপনি একটি বাফার জোন তৈরি করতে চান, তবে সেখানে সৈন্য রাখতে হবে। আর তারা হবে হিজবুল্লাহর আদর্শ লক্ষ্যবস্তু।”

এর ফলে ইসরায়েল তার ‘সীমিত’ পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে নতুন করে লেবাননে সামরিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়বে। এর পাশাপাশি, হিজবুল্লাহর কাছে এমন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বড় মজুদ রয়েছে যা লেবাননের যে কোনো স্থান থেকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে বাফার জোন উত্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসরায়েল কতদূর যেতে রাজি তা নৈতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে এখনও পরিষ্কার নয়। গ্যাটোপোলোস বলেন, “ইতিহাস যদি নির্দেশক হয়, তবে এটি ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত বিশৃঙ্খল এক অভিযান হতে চলেছে।”

পরিশেষে বলা যায়, লেবাননে ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান এক নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, যা ২০০৬ সালের যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করবে।

Tags

- Advertisement -