শেষ রজনী

ভোর রাত। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। কোথাও কোন শব্দ নেই। নেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও। জোনাকীরাও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃক্ষ-লতা, গুল্মরাজিও ঘুমের ঘরে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাতাসও। গাছের পাতা নড়ার মধ্য দিয়ে বাতাসের চঞ্চলতার টের পাওয়া যায়। এখন গাছের পাতারাও এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। জেগে নেই বৃক্ষের ডালে বাসা বাঁধা বিহঙ্গও। জেগে নেই গৃহপালিত প্রাণিও। শিয়াল কুকুরের হাঁকডাকও শোনা যায় না। শোনা যায় না বিড়ালের ইঁদুর তাড়ানোর শব্দও। সময় হয়নি মোরগ ডাকারও। এমনি সময় ঘুম ভাঙ্গে শাহেদের। বিছানায় হাতড়িয়ে মোবাইলে সময় দেখে নেয়। রাত তিনটা। ভোর হতে এখনো অনেক সময় বাকী। রাতে ঘুমুনোর সময় মোবাইলে এলার্ম দিয়ে শুয়েছিল। ভোর চারটায় উঠার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই নিয়ে তার বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙে যায়। খবরের বিভৎস চিত্রটা তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই ঘুমুতে চেষ্টা করেছে।

একটু চোখ লাগলেও পরক্ষণেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এভাবেই তার রাত গত হচ্ছে। ঘুমের ঘরে খবরের বিভৎস চিত্রটা তাকে খুব জ্বালাতন করছে। একেবারেই ঘুমুতে দিচ্ছে না। সকালে উঠে কাজে যেতে হবে। তাকে ঘুমুতে হবে। কিন্তু সেই দৃশ্যটা মোটেও তার পিছু ছাড়ছে না। তাই সে বার বার ঘুমুনোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। শাহেদ খেয়াল করল, তার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। হাল্কা একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ঠিক মতো ঘুমুতে না পারলে তার এটি হয়ে থাকে। আজোও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে ব্যথাটা তীব্রতর হচ্ছে। তাই আর ঘুমুনোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো না। বিছানা ছেড়ে উঠতে মনস্থ করলো। কিন্তু ব্যথাটার কী হবে? আবার এখন যদি ঘুমুনোর চেষ্টা করে সফল হয়ে যায়, তাহলে চারটায় উঠতে পারবে না এটা নিশ্চিত। চারটায় একটা বিশেষ কাজ আছে তার।

এটা তাকে করতেই হবে। অন্যের দ্বারা বাধিত নয়, নিজ থেকেই নিজেকে এ কাজে বাধ্য করে নিয়েছে মাস দুয়েক হচ্ছে। এর আগে সেও বেখবর ছিল। অন্যান্য যুবকদের মতো সেও রাত জাগতো। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে মোবাইলে ফেসবুক ইউটিউবসহ নানা ওয়েব সাইট ঘেঁটে ঘেঁটে সংবাদ, আজব খবর ইত্যাদির পাশাপাশি নানা ধরনের কীর্তি কলাপ দেখতো। বিশেষত যুবক বয়সে যে সব বিষয়ের প্রতি কৌতূহল জন্মায় বা বন্ধুদের কর্তৃক প্ররোচিত হয়, সে সব বিষয় দেখলে চোখ আটকে যেত তার। শাহেদ একটি বেসরকারি এনজিওতে চাকরি করে। সহকারী ম্যানেজার। কিছুদিন হয়, তার বস ম্যানেজারের সাথে একটা বিষয় নিয়ে তার তর্কাতর্কি হয়েছে। ম্যানেজার সাহেব সব্যসাচী শাহেদের এই আচরণ মেনে নিতে পারেননি। সে বিষয়টি খুব করে মনে রেখেছেন। এর আগে ম্যানেজারের সাথে শাহেদের খুব ভাব ছিল। দুজনের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল।

শাহেদের অন্যায়ে ছাড় দেয়ার মানসিকতা মোটেও নেই। আর তাই তেমনই একটি বিষয় নিয়ে ম্যানেজারের সাথে শাহেদের মনোমালিন্য হয়। এটাকে কেন্দ্র করে ম্যানেজারের সাথে শাহেদের দূরত্ব বাড়ে। আগের মত আর দুজনের মাঝে ভাব নেই। কাজ কর্মে একজন আগের মত অন্যজনকে ডাকেও না। যে যার গতিতে কাজ করে। এভাবে দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলে। সমন্বয়হীনতার অভাবে কাজে ব্যাত্যয় ঘটে। ভুল বুঝাবুঝির পরিমাণটাও বাড়তে থাকে সমান তালে। কিছুদিন পর সেই ম্যানেজার কিছু কিছু বিষয়ে শোকজ খান। পরে যথাসময়ে শোকজের উপযুক্ত জবাব দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত হন। এর দোষটা গিয়ে শাহেদের উপর পড়ে। ম্যানেজার সন্দেহ করে, তার খুঁটিনাটি বিষয় শাহেদ ছাড়া অন্য কেউ উপরের কর্তাদের জানানোর কথা না।

যেহেতু এর আগে শাহেদের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে এবং একে কেন্দ্র করে দূরত্ব বেড়েছে, তাই শাহেদই প্রতিশোধ নেবার জন্যে তার অনিয়ম সম্পর্কে উপর মহলকে অবহিত করেছে। যে সব বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে, তা অন্য কেউ উপর মহলকে অবহিত করার কথা না। ম্যানেজারের ধারণা, শাহেদ ছাড়া অন্য কেউ এ কাজটি করতে পারে না। যদিও তার অনিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য কলিগরাও অবগত। কিন্তু তারাতো তার বাধ্যগত। তারা অসঙ্গতিকে মানিয়ে নিয়ে চলে। শাহেদ যেহেতু কোন অসঙ্গতি সহ্য করতে পারে না, তাই উপর মহলকে শাহেদই অবগত করেছে। অন্য কেউ নয়। এরই সূত্র ধরে ম্যানেজার বাদী হয়ে শাহেদকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। শাহেদকে থানায় দেখা করার কথা বলে ডেকে নিয়ে রাতারাতি গ্রেফতার করে চালান করে দেয়া হয়। শাহেদ থানায় যাবার সময় তার এক কলিগকে সাথে নিয়েছিল। তার মাধ্যমে শাহেদের স্ত্রী জানতে পারে শাহেদকে গ্রেফতার করে চালান করা হয়েছে। শাহেদ চাকরিসূত্রে স্ত্রী সন্তান নিয়ে অফিসের কাছেই ভাড়া বাসায় থাকেন। যখন তার স্ত্রী খবর পায় তখন রাত সাড়ে বারোটা।

এত রাতে কী করবে কিছুই ভেবে পায়নি তার স্ত্রী। সে শাশুড়িকে ফোন দেয়। শাশুড়ি পরদিন সকালে তার দেবর-ভাসুরসহ গিয়ে জেলখানায় শাহেদের সাথে দেখা করে। ঘটনার বিবরণ শুনে তারা শাহেদকে ধৈর্য্য ধরতে বলেন এবং আল্লাহকে ডাকতে বলেন। মামলা পরিচালনার জন্য খুব শীঘ্রই উকিল নিয়োগ করা হবে আশ্বস্থ করে তারা বাড়ি ফিরে যান। শাহেদ হাজতখানায় বন্দি। ক্ষণে ক্ষণে তার মায়ের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানদের কথা। বাইরের জগতের কথা। বাইরে সবাই কতো স্বাধীন। ইচ্ছে মতো মুক্ত আকাশে পাখির মত ঘুরে বেড়ায়। আর এখানে সে লোহার খাঁচায় বন্দি। বাইরের মানুষের কথা চিন্তা করে। চিন্তা করে তার বন্দিদশার কথা। বাইরের মানুষের জীবন আর তার বন্দি জীবনের মাঝে কতো তফাৎ চিন্তা করে। চিন্তা করতে করতে খুঁজে পায় জেলখানার বাইরের মানুষ যেন দুনিয়ার জগতে আছে আর বন্দিরা যেন আছে কবর জগতে। যেমনিভাবে কবরের বাসিন্দারা দুনিয়ার মানুষদের দেখতে পায়, তাদের আচার আচরণ অনুভব করতে পারে, কিন্তু দুনিয়ার বাসিন্দারা কবরের মানুষের কোন কিছুই আঁচ করতে পারে না। হাজত জীবনের মাঝে সে এমন উপলব্ধিই অর্জন করে। হাজতখানায় বসে বসে দিন গুণে। স্বাভাবিক নিয়মেই সূর্য উঠে, সূর্য ডুবে। দিন আসে, দিন যায়। রাত্রি নামে, রাত্রি পোহায়। কিন্তু শাহেদের সময়তো আর কাটে না। ভোর হলে সন্ধ্যে হয় না, রাত এলে সকাল যেন হতেই চায় না। অন্যদেরতো তাস খেলে, বিড়ি টেনে সময় যায়।

সেতো এসব কিছু করে না। দিনের বেলায় অন্যদের সাথে কথা বলে, আড্ডা মেরে সময়তো যায়, কিন্তু রাত নিয়ে বড় বিপাকে। এত বড় রাত কিভাবে পার করবে? শাহেদ নামাযী মানুষ। তবে নিয়মিত নয়, অনিয়মিত। নানান অজুহাতে কখনো বিনা অজুহাতে নামায না পড়াটা বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল শাহেদের। জেলের ভেতরে অজুহাত দেয়ার মত কিছু নেই। কোনো কাজ নেই। অলস সময় কাটানো বড় দায়। তার উপর অজুহাত আসবে কোত্থেকে। বরং নিজ থেকে পরিশ্রম করতে হয় শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্যে, অনর্থ লাফালাফি করতে হয়। নতুবা অলস শুয়ে বসে থাকতে থাকতে শরীরে বাত রোগে আক্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। শাহেদ চিন্তা করে নিজেকে অনেক ঠকিয়েছে। আমার ইবাদত আমার সঙ্গী। আমার ইবাদাত আমার মুক্তি। হুকুম আল্লাহর। উপকার আমার। আল্লাহর হুকুম আমার মানা না মানার মাঝে আল্লাহর কোন লাভ-ক্ষতি নেই। তবে, বান্দা তার হুকুম পালন করলে তিনি খুশি হন। আনুগত্যশীল বান্দার প্রতি উদার হন। এসব চিন্তা করে শাহেদ সিদ্ধান্ত নেয়, আর নিজেকে ফাঁকি দেবে না।

নিজের প্রতি নিজে আর অবিচার করবে না। নিজেকে নিজে আর প্রতারিত করবে না, ঠকাবে না। এখন থেকে নিয়মিত নামায আদায় করবে। আল্লাহর হুকুমসমূহ মেনে চলবে। অলসতা আর অজুহাতকে মনে ঠাঁই দেবে না। যেই ভাবনা সেই কাজ। সেই থেকে শাহেদ আর নামায কাযা করে না। হাজতখানায় থেকে ভোর রাতে উঠে তাহাজ্জুতের নামায পড়ার একটা অভ্যেস গড়ে উঠেছে তার মাঝে। হাজতখানায় যে কয়দিন ছিল, সে কয়দিন তাহাজ্জুত বাদ দেয়নি। হাজতখানা থেকে ফিরেও অভ্যেসটা ধরে রাখার চেষ্টা করছে।

কিন্তু মাঝে মাঝে বাদ পড়ে যায়। নানান অজুহাতে বাদ পড়ে যায়। শেষ রজনীতে অর্থাৎ ভোর চারটায় তার জরুরি কাজ এটাই, সে তাহাজ্জুতের নামায আদায় করবে। আজ আর কোন অজুহাতে সে এটা ছাড়তে চাচ্ছে না। সে আজ দয়াময় প্রভুর কাছে একটি জিনিস চাইবে। বিশেষ কিছু আল্লাহর কাছে চাইতে হলে ভোর রাতে তাহাজ্জুতের নামায পড়ে চাওয়া সবচেয়ে উত্তম। বিশেষ বিষয়টা একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে। তা হলো একটা ঘটনা তাকে খুব করে পীড়ন দিচ্ছে, তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যেয় ইউটিউবের খবরে দেখেছে, অনেকের অভিযোগ- ভারতের হিন্দু মৌলবাদী কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লিতে বিভিন্ন ইস্যুতে বিশেষত রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে হিন্দু-মুসলিমের মাঝে দাঙ্গা ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা সংখ্যালঘু মুসলিমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও হত্যার শিকার হচ্ছে। মুসলমানদের মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ দৃশ্য তার চোখ থেকে সরছেই না। ঘুমের ঘরে বার বার এ দৃশ্যটি তাকে পীড়া দিয়েছে। ঘুমুতে দেয়নি। তাই বার বার তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক হাসান কবীর

Tags

- Advertisement -