হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পেজার বিস্ফোরণ

লেবাননে বছরের শুরুতে পৌঁছানো অস্ত্রসজ্জিত পেজারগুলো ছিল ইসরায়েলের হিজবুল্লাহকে ধ্বংসের পরিকল্পনার অংশ। পেজারগুলোতে এমন বৈশিষ্ট্য ছিল যা প্রাথমিকভাবে ধরা পড়েনি। তবে এগুলোর গঠন ও কৌশল মধ্যপ্রাচ্যকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

লেবাননের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এই পেজারগুলোর ব্যাটারিতে ছোট আকারের একটি প্লাস্টিক বিস্ফোরক এবং এমন একটি ডেটোনেটর ছিল যা এক্স-রে মেশিনেও ধরা পড়তো না। এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে ইসরায়েলি এজেন্টরা ভুয়া অনলাইন স্টোর ও পেজ তৈরি করে হিজবুল্লাহকে বিভ্রান্ত করে। রয়টার্সের কাছে পেজারগুলোর ব্যাটারি প্যাকের ছবি এসেছে, যা থেকে এর গোপন নকশার তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে।

ইসরায়েল বহু বছর ধরে ইরান-সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহকে দুর্বল করার পরিকল্পনা করছিল। এই পেজারগুলোর বিস্ফোরণের মাধ্যমে তারা নজিরবিহীনভাবে হিজবুল্লাহকে আঘাত হানে। পেজারগুলোর ভেতরে একটি পাতলা শিটের মাধ্যমে প্রায় ছয় গ্রাম সাদা প্লাস্টিক বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল। সেটি ব্যাটারির দুটি সেলের মাঝে লুকিয়ে ছিল এবং বাইরের কাঠামোও অত্যন্ত সাধারণভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সন্দেহ না জন্মায়।

যে বিস্ফোরকটি ব্যবহার করা হয়েছে তা সাধারণত মিনি ডেটোনেটর ব্যবহার করে সক্রিয় হয় না। এর ডেটোনেটরটি ছিল বিশেষভাবে তৈরি। ধাতব উপাদানবিহীন এই ডেটোনেটর প্লাস্টিক বিস্ফোরকের মতোই এক্স-রে মেশিনে ধরা পড়েনি। ফেব্রুয়ারিতে হিজবুল্লাহ পেজারগুলো হাতে পাওয়ার পর এগুলোর মধ্যে বিস্ফোরক আছে কিনা তা পরীক্ষা করলেও কিছুই সন্দেহজনকভাবে ধরা পড়েনি।

হিজবুল্লাহর হাতে যখন এই পেজারগুলো ছিল, তখন তারা লক্ষ্য করে যে ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে এতে তেমন কোনো উদ্বেগ সৃষ্টি হয়নি। ১৭ সেপ্টেম্বর যখন এই পেজারগুলো একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়, তখন তা হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। হাজার হাজার পেজার একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয় এবং এ ঘটনায় ৩৯ জন নিহত ও ৩৪০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হন। আহতদের অনেকের চোখে, পেটে এবং আঙুলে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন ছিল।

এ ঘটনায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে এই হামলার জন্য ইসরায়েল সরকার কোনো সরাসরি মন্তব্য করেনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট মোসাদের কার্যক্রমের প্রশংসা করে বক্তব্য দেওয়ার পর এই পরিকল্পনায় ইসরায়েলের জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকে নিশ্চিত বলে মনে করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তারা এই হামলার বিষয়ে আগে কোনো তথ্য পাননি।

এখন পর্যন্ত লেবাননের তথ্য মন্ত্রণালয় এবং হিজবুল্লাহ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। ইসরায়েলও তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কিছু জানায়নি।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঘটে যাওয়া এক বিস্ফোরণ ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে চলমান সংঘাতের একটি গভীর ষড়যন্ত্রের পর্দা ফাঁস করেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা তৈরি এক বিশেষ পেজার এবং তার শক্তিশালী ব্যাটারি ছিল এ হামলার মূল অস্ত্র, যা হিজবুল্লাহর নেতৃত্বকে ফাঁদে ফেলতে ব্যবহৃত হয়। এই ঘটনার পেছনের কৌশল এবং প্রতারণার বিস্তৃত বর্ণনা উঠে এসেছে।

প্রথম নজরে, পেজারের ব্যাটারি দেখতে সাধারণ লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মতো মনে হয়েছিল, যেগুলো সাধারণত ইলেকট্রনিক পণ্যে ব্যবহার করা হয়। তবে ব্যাটারির গায়ে লেখা ছিল LI-BT783—একটি মডেল যা আসলে বাজারে বিদ্যমানই ছিল না। ইসরায়েলি এজেন্টরা এই অস্ত্র তৈরির জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি গল্প তৈরি করে এবং এই পেজারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও পণ্য বাজারজাত করে। তাদের প্রতারণার অন্যতম লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহ, যারা তাদের কেনাকাটায় অত্যন্ত সতর্ক এবং কঠোর যাচাই-বাছাই করে থাকে।

একজন সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি সরাসরি এ অভিযানে যুক্ত ছিলেন না, জানিয়েছেন, হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনকে প্রতারণার জন্য এমন কিছু তৈরি করতে হয় যা দেখে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। “আপনার এমন কিছু নিশ্চিত করতে হবে যা খোঁজাখুঁজিতে পাওয়া যাবে। কিছুই না পাওয়া গেলে সন্দেহের উদ্রেক হয়,” বলেন ওই কর্মকর্তা।

পেজারের জন্য ব্যবহৃত মডেলটির নাম ছিল AR-924। এটি বাজারজাত করা হয়েছিল তাইওয়ানের সুপরিচিত ব্র্যান্ড ‘গোল্ড অ্যাপোলো’র অধীনে। কোম্পানির চেয়ারম্যান হসু চিং-কুয়াং জানান, তিন বছর আগে তার সাবেক কর্মচারী তেরেসা উ এবং তার “বড় বস টম” তার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি লাইসেন্স চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। চুক্তির মাধ্যমে তাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয় নতুন পণ্য ডিজাইন করার এবং সেগুলো গোল্ড অ্যাপোলো ব্র্যান্ডের অধীনে বাজারজাত করার। তবে হসু দাবি করেন, তিনি পেজারের প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না এবং তার কোম্পানি এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে AR-924 পেজার এবং তার ব্যাটারির ছবিসহ তথ্য গোল্ড অ্যাপোলো’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ‘অ্যাপোলো সিস্টেমস’ নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়, যেখানে পেজার এবং ব্যাটারির অতিরিক্ত তথ্য দেওয়া হয়। যদিও এসব পণ্য সরাসরি কেনা সম্ভব ছিল না, ইসরায়েলি এজেন্টদের তৈরি করা প্রতারণার এই প্রচেষ্টা হিজবুল্লাহর নজর এড়িয়ে যায়।

বিস্ফোরণের পর হিজবুল্লাহ তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে। তারা বুঝতে পারে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এক ধরণের আগ্রাসী বিক্রয় কৌশলের মাধ্যমে এই পেজার তাদের কাছে পৌঁছায়। হিজবুল্লাহর একজন সূত্রের মতে, বিক্রেতারা এ পেজার এত কম দামে সরবরাহ করতে চেয়েছিল যে হিজবুল্লাহর ক্রয় ব্যবস্থাপক এটিকে কেনার সিদ্ধান্ত নেন।

এই বিস্ফোরণ এবং হামলার পর লেবাননের শীর্ষ কর্তৃপক্ষ একে তাদের দেশের সার্বভৌমত্বের মারাত্মক লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে। ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, ইসরায়েলের আক্রমণের পর হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ বলেন, এই আক্রমণ যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য এবং এর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

অক্টোবরের শুরু থেকে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকে, যার ফলে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের স্থল ও বিমান হামলা শুরু হয়। ইসরায়েলের এই অভিযানে হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বের বেশিরভাগই নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে পেজার কেলেঙ্কারির তদন্তকারী কর্মকর্তা নাবিল কাওকও আছেন।

Tags

- Advertisement -