“৮,৩০০ কোটি টাকার এসপিএম প্রকল্প: অপারেটরের অভাবে ৬ মাস ধরে নিষ্ক্রিয়”

৮,৩০০ কোটি টাকার সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প গত ছয় মাস ধরে অপারেটরের অভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আছে। প্রকল্পটি কমিশনিং হওয়ার পর থেকেই অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে বিলম্বের কারণে আমদানি করা জ্বালানি তেল সমুদ্রপথে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি পরিশোধনাগার (ইস্টার্ন রিফাইনারি) পর্যন্ত নিয়ে আসতে প্রতি মাসে ৬৬ কোটি টাকার ব্যয় করতে হচ্ছে।

কক্সবাজারের মাতারবাড়ী দ্বীপ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে সাগরের তলদেশে অবস্থিত এই ভাসমান বয়া দুটি পাইপলাইনের সাথে সংযুক্ত, যার মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর। মাদার ট্যাংকার থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রথমে মহেশখালী ট্যাংক টার্মিনালে পৌঁছায় এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংক টার্মিনালে নেওয়া হয়।

এই প্রকল্পটি চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের নিরীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্বে আমদানি করা জ্বালানি তেল বড় জাহাজ থেকে ভাড়া করা লাইটার জাহাজে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে আনা হত, যার জন্য সময় লাগত ১১-১২ দিন। এসপিএম প্রকল্পটি চালু হলে একই পরিমাণ তেল পরিবহনে সময় লাগবে মাত্র দুই দিন, যা বছরে ৮০০ কোটি টাকার সাশ্রয় নিশ্চিত করবে।

এছাড়া, প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীতে নির্মিত ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক ইস্টার্ন রিফাইনারির জ্বালানি তেল ধারণের সক্ষমতা দুই লাখ টন বৃদ্ধি করেছে, ফলে এখন আড়াই মাসের চাহিদার সমান তেল মজুদ করা সম্ভব। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত সরবরাহ ব্যাহত হলে অতিরিক্ত নিরাপত্তা মজুদ রাখতে সহায়তা করবে।

কিন্তু, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের জন্য এখনো অপারেটর নিয়োগ না হওয়ায় এসব সুফল অধরাই রয়ে গেছে। গত বছরের জুলাইয়ে প্রকল্পের পরীক্ষামূলক তেল খালাস কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়, এবং মার্চে এটি চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে কেন অপারেটর নিয়োগ হয়নি, সে বিষয়ে ইআরএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ হাসানের সাথে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, এসপিএমের জন্য অপারেটর নিয়োগে ৩ থেকে ৬ মাস সময় লাগতে পারে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) এর আওতায় ঠিকাদার নিয়োগের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এসপিএমের জন্য অপারেটর নিয়োগে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা আশা করছি, তিন-চার দিনের মধ্যে সেটি আমরা পাব। সুপারিশগুলো হাতে আসার সাথে সাথে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করব।” 

এসব সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি খাতের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এসপিএম প্রকল্পের বিলম্বের কারণ এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিতে বিপিসির দৃষ্টিভঙ্গি-

দেশের জ্বালানি খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, সাবমেরিন পাইপলাইন ম্যানেজমেন্ট (এসপিএম) নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। প্রকল্পটি চালুর জন্য বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত বিভিন্ন কারণে এই বিলম্ব হচ্ছে। প্রথমত, পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ১৮ মাস একটি দক্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসপিএম পরিচালনার কথা ছিল। দ্বিতীয় বছর থেকে বিপিসি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল।

তবে প্রকল্পের আকার ও জটিলতার কারণে, স্থানীয় অপারেটররা এই ধরনের প্রকল্প পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হচ্ছিল না। তাই, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এসপিএম চালুর পরপরই দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক অপারেটর নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। নির্মাণকাজ করা চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড এসপিএম পরিচালনার আগ্রহও প্রকাশ করে, যা সরকারের পর্যালোচনায় ছিল।

বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) অনুপম বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, “প্রকল্পের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড তিন বছরের জন্য এসপিএম পরিচালনার আগ্রহ দেখিয়েছে। বিশেষ জ্বালানী নিরাপত্তা বিধানের আওতায় এই প্রস্তাবনা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটিও গঠন করে মন্ত্রণালয়। কমিটি দুটি সভাও করে। তবে জুলাই মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য এই প্রক্রিয়া থমকে পড়ে।”

বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর আওতায় এসপিএমের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের প্রক্রিয়াগুলো ত্বরান্বিত করতে যেকোনো চুক্তি স্বাক্ষরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এ ধরনের চুক্তি নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে বিশেষ জ্বালানী নিরাপত্তা বিধান বাতিল করা হয়। এখন পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশনের (পিপিআর) আওতায় উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ দিতে হবে।

অনুপম বড়ুয়া বলেন, “এসপিএম প্রকল্পটি মূলত বিশেষ জ্বালানী নিরাপত্তা বিধানের আওতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। তবে সরকার পরিবর্তনের পর সেটি বাতিল হওয়ায় অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। বর্তমানে আমরা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশনের (পিপিআর) আওতায় ঠিকাদার নিয়োগের চেষ্টা করছি। এজন্য আমরা ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়েছি। দ্রুত পরামর্শ পাওয়া গেলে লিমিটেড টেন্ডারের মাধ্যমে নিয়োগ করা যাবে। নাহলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করতে গেলে সময় বেশি লাগবে। এসপিএমের জন্য বিদেশি অপারেটরের ওপর নির্ভর করতে হতে পারে।”

এসপিএম প্রকল্পের বিলম্বের কারণে দেশের জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে দ্রুততর সময়ে এটি চালু করার প্রয়োজনীয়তা এখন আরো অনুভূত হচ্ছে। প্রকল্পটি চালু না হওয়ায়, বর্তমানে দুটি লাইটার জাহাজের মাধ্যমে তেল আনতে হচ্ছে ইস্টার্ন রিফাইনারির প্ল্যান্টে।

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ফলে এই পরিস্থিতির গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। ওইদিন সকালে জ্বালানি তেল নিয়ে ইআরএলের জেটিতে আসার সময় ভাড়া করা দুটি লাইটার জাহাজের একটি, বাংলার জ্যোতি, বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনায় তিনজনের প্রাণহানি ঘটে এবং বিস্ফোরণটি দেশের একমাত্র শোধনাগারের খুব কাছাকাছি ঘটে। এতে শোধনাগারে আগুন ছড়িয়ে পড়লে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারত। এ কারণে পুরোনো জাহাজে তেল পরিবহন বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য এক গুরুতর ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০১৫ সালে এসপিএম প্রকল্প নেয় ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড, যার উদ্দেশ্য ছিল মাদার ভেসেল থেকে শোধনাগারটিতে জ্বালানি তেল পরিবহনের সময় ও ব্যয় উভয়ই সাশ্রয় করা। প্রকল্পটি একাধিকবার সংশোধিত হওয়ায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত নির্মাণ কাজ, ডলারের বিনিময় হারের পরিবর্তন এবং কর বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা থেকে ৮ হাজার ২২২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

গত বছরের জুলাইয়ে সৌদি আরবের ৮২ হাজার টন একটি জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ (মাদার ভেসেল) থেকে প্রথমবারের মতো পাইপলাইন দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়, কিন্তু একটি বড় কারিগরি ত্রুটির কারণে সাগর থেকে পাইপলাইনে মহেশখালীর কালারমার ছড়ায় তেল নিয়ে আসার উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। পরে ত্রুটি সারিয়ে তা শুরু করতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

প্রকল্পের মেয়াদ সবশেষ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। অবশেষে প্রকল্প হাতে নেওয়ার ৯ বছর পরে মার্চে এটি কমিশনিংয়ে আসে। এখন অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে এসপিএম প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে রয়েছে। তবে বিলম্বের ঘটনা ঘটছে, যা অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।

২০১৯ সালের শুরুতে চীন সরকারের প্রিফারেন্সিয়াল ঋণ সুবিধার সহায়তায় ডুয়েল-চ্যানেল এসপিএম ব্যবস্থার নির্মাণকাজ শুরু হয়, যেখানে অর্থায়ন করে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না। চীন প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট বাবদ ৪৬৭.৮৪ মিলিয়ন এবং সফট লোন বাবদ ৮২.৫ মিলিয়ন ডলার দেয়। বার্ষিক ২ শতাংশ সুদে ২০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে, আর গ্রেস পিরিয়ড হচ্ছে পাঁচ বছর।

এসপিএম প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শীঘ্রই কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর, যাতে দেশের জ্বালানি সংকটের সমাধান সম্ভব হয় এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

Tags

- Advertisement -