দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার হুমকি

উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে ভারত মহাসাগর দিয়ে বেষ্টিত দক্ষিণ এশিয়ায় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বাস করে,তাই এটি পৃথিবীর অন্যতম জনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। আফগানিস্তান ব্যতীত বাকি সবগুলো দেশ ভারতের সাথে স্থলপথ ভাগ করে বিধায় এই অঞ্চলে ভারতের দাদাগিরি অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে বেশিই দেখা যায় । নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ন,অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ এর ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে সমাদৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব এবং চীনের দক্ষিণ এশিয়ার প্রবেশের মাধ্যমে এ অঞ্চলের রাজনীতি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে।

শান্তি ও নিরাপত্তার মাপকাঠিতে মাপলে বিভিন্ন অনিরাপত্তার উৎস এখানে উপস্থিত আছে, যারা এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকিস্বরুপ। দক্ষিণ এশিয়া যেহেতু পৃথিবীর সর্বোচ্চ জনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র অঞ্চল তাই এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত স্বাভাবিকভাবেই কষ্টকর।

সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়ার প্রবল ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যা এ অঞ্চলের সংঘাত ও  অনিরাপত্তার অন্যতম কারণ। পৃথিবীর কিছু কুখ্যাত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যেমন  কুকি-চিন, LET, HUM,  উলফা, LITE সহ বেশকিছু স্বাধীনতাকামী সন্ত্রাসী বাহিনী এই অঞ্চলে অবস্থিত। এই সন্ত্রাসবাদ যুগে যুগে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি প্রভাবিত করেছে,বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যু, ভারতের হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা এবং মাদকদ্রব্য জাতীয় অপরাধে।

দক্ষিণ এশিয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম, বিশ্বের চারভাগের এক ভাগ মানুষ এখানে বাস করে। এই বিপুল জনগণের মাঝে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু রাষ্ট্র আবার শরণার্থী সমস্যার জর্জরিত। ইউরোপের পরে আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ায় বেশি। ভারত পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিন দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় ইস্যু এই শরণার্থী সমস্যা। ভারতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আগত শরণার্থী ও পাকিস্তানের প্রচুর আফগান শরণার্থী রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় বাধা এই শরণার্থী সমস্যা। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার হতে বিভিন্ন সময় বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশী প্রবেশ করেছে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী অতীতের তুলনা যেমনই বেশি তেমনই এর চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য চিন্তার কারণও বটে । মিয়ানমারে মিলিটারির নিধনযোগ্য থেকে বাঁচতে ২০১৭  সালে প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০২৩ সালে এ শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২ লক্ষেরও বেশি। শুধু বাংলাদেশ না ভারত এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের জন্য এ শরণার্থী সমস্যা একটি হুমকির কারণ। যেকোনো দেশেরই এত বিশাল সংখ্যক শরণার্থী কে আশ্রয় দেওয়া ভরণ পোষণ করা ও পরিকল্পিত পুনর্বাসন করা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। শরণার্থী সমস্যা সকল দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য উদ্যোগজনক। মিয়ানমার হতে আগত এই রোহিঙ্গা শরণার্থী সহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘিষ্ঠ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

দেশ বিভাজনের পর থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে । ক্ষমতার লড়াই এই দেশ দুটির মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি করেছে । দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিশালী দেশ বলতে ভারত এবং পাকিস্তানের নাম আগে আসে। মধ্যে দেশ দুটির মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে এবং বর্তমানে প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে চলছে চরম বৈরীভাব। দক্ষিণ এশিয়ার স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় এই দুই দেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই ভারত – পাকিস্তান দ্বন্দ্ব  উল্টো  হুমকি হিসেবে কাজ করছে, পাকিস্তান ভারতের বৈরিতা মূল হচ্ছে কাশ্মীর সমস্যা, যে কারণে কাশ্মীর বিষয়ে সমস্যা তাই হবে পাকিস্তান ভারতের সমস্যার সমাধানের প্রথম ধাপ। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কাশ্মীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।  ৫ আগস্ট ২০১৯ সালে, ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্বু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা তুলে নেয় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। কাশ্মীরকে ঘিরে উত্তেজনা এই রায় প্রকাশের পর থেকে আরও বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া ছিল পূর্বের চেয়েও কঠোর, ভারতের সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া কিছু পদক্ষেপ নিয়ে। অধিকৃত জম্বু কাশ্মীরে বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা ভারতের সাথে সব ধরনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাতিল করার পাশাপাশি দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করার ঘোষণা দেয় পাকিস্তান। দুই দেশে ট্রেন পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায় এবং রাষ্ট্রদূতকে সরিয়ে আনা হয় । ভারত পাকিস্তানের সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলিও হয়।  5 জন ভারতীয় সৈন্য ও ৩জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। দুই দেশের মাঝে তখন থেকে উত্তেজনা এখনো চলমান রয়েছে । কাশ্মীর সংকট ছাড়াও পাকিস্তান ভারত দ্বন্দের  অন্যান্য কিছু কারণ আছে যা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরপ। চীন কেন্দ্রিক পাকিস্তানে পররাষ্ট্রনীতিও ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরুপ মনে করা হয়। ২০১৭ সালের ডোকলামে সীমান্ত উত্তেজনা পর থেকে ভারত চীনের শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে । পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশের পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধ হওয়ার ফলে এই দুই দেশের দ্বন্দ্ব গোটা অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশে পারমাণবিক প্রতিযোগিতার কারণে সীমান্ত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সর্বোপরি হুমকির মুখে পড়ছে উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা।

দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলো মাদকের সর্বনাশা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে বন্দী। সীমান্তবর্তী দেশগুলো থেকে মদ, গাজা, ইয়াবা, হিরোইন অবাধে  এক দেশ হতে অন্য দেশে চালান হচ্ছে। এগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বিভিন্ন মাদকসমাজ, যা দ্বারা নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আন্তরাষ্ট্রীয় এই অপরাধ গুষ্টি প্রভাবিত করছে দেশগুলো শান্তি ও নিরাপত্তাকে। মাদক ছাড়াও অস্ত্রের  অবৈধ চোরাচালন ও মানব পাচারের সাথে দক্ষিণ এশিয়ান দেশসমূহ জড়িত হচ্ছে। এই মাদক অপরাধপ্রাচার দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য শুধু হুমকি না বরং এশিয়ার জন্য উদ্যোগজনকও বটে।

সম্প্রতি চীন ভারতের সীমান্ত সংঘাত ও অঞ্চলের শান্তিও নিরাপত্তা  এবং স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে । এছাড়াও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের সীমান্তবিরোধ  বেশ লক্ষ্য করা যায়। ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা ও জলধার নিয়ে নেপাল তার জাতীয় মানচিত্রে পরিবর্তন এনেছে এবং পরিবর্তিত মানচিত্র পার্লামেন্টে সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এ কারণে ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে। সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো প্রায়ই অভিযোগ উত্থাপন লক্ষ্য করা যায়।

দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন আশঙ্কা জনক এবং উদ্বেগের কারণ। ধারণা করা হয় যে ২০৫০ সালের মালদ্বীপ সম্পূর্ণরুপে এবং শ্রীলংকা,  ভারত এবং বাংলাদেশ দক্ষিণ অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রখর সমস্যা যা এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।

নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়া বর্তমানে ভৌগলিক ও কৌশলগত কারণে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচ্য। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এবং মধ্য এশিয়ার মাঝে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়া ভারত মহাসাগর এবং বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের যোগ্য অধিকারী। এ মহাসাগর গুরুত্ব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুধু সম্পদের না বরং ক্ষমতারও। চীন এখানে সামরিক ঘাটি স্থাপন এবং সাবমেরিন এর মাধ্যমে নিয়মিত গুপ্তচরবৃত্তি  করে। ভারত সরকার চীনের এই অগ্রহণযোগ্য কার্যক্রম আলোচনা করেছে এবং ওই অঞ্চলে নিয়মিত সামরিক  প্রস্তুতি বাড়িয়ে তুলছে। উদীয়মান পরাশক্তি চীন এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ করুক তা যুক্তরাষ্ট্র  চায়না । তাই ভারতের সাথে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রও যোগ হচ্ছে।

দারিদ্র্যের সমস্যাও দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্বের অধিক সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতে। এছাড়া বাংলাদেশ নেপাল ভুটান ও পাকিস্তানের জাতীয় সমস্যা হিসেবে দারিদ্রতাকে  চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

দক্ষিণ এশিয়া ঐতিহাসিক, ভৌগলিক  এবং জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। এ অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার  বিভিন্ন হুমকি বিদ্যমান থাকলেও তা অবসান করতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত বিশেষ শক্তিশালী অঞ্চল হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে মনে করি। তাই এ অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরী।

Tags

- Advertisement -