মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের দুইবারের বেশি নির্বাচিত হওয়ার সীমাবদ্ধতার কারন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার মূল স্তম্ভগুলির মধ্যে একটি হল ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং দায়িত্বশীলতা। এই উদ্দেশ্যে, ২২তম সংশোধনী (১৯৫১) সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে যা নিশ্চিত করে যে একজন প্রেসিডেন্ট দুইবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না। এই প্রতিবেদনে আমরা এই সীমাবদ্ধতার পেছনের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, এবং প্রভাব বিশ্লেষণ করব, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র পরিচালনা ও গণতন্ত্রকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে সাহায্য করবে।

ইতিহাস ও পটভূমি-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুটি টার্মের সীমা নির্ধারণের আগে, একাধিক প্রেসিডেন্ট দীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিলেন। তবে, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের শাসনকাল এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। রুজভেল্ট ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মোট চারটি নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং ১২ বছর ক্ষমতায় থাকেন। তার দীর্ঘকালীন শাসন কেবল তার ব্যক্তিগত নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল না, বরং এটি একটি নতুন ধরনের ক্ষমতা ব্যবস্থার ধারণা তৈরি করেছিল যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। তার শাসন আমেরিকান রাজনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ঝুঁকি নিয়ে আসে, যা পরবর্তীতে ২২তম সংশোধনী প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার পেছনের অন্যতম প্রধান কারণ।

ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের প্রভাব-
ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডেন্ট। মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্ব দেশকে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটের মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। তার দীর্ঘকালীন শাসন একটি ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদী শাসনের সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করে এবং শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই প্রেক্ষাপটে, রুজভেল্টের সময়কাল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য একটি শক্তিশালী সিগন্যাল ছিল যে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা প্রয়োজনীয়। তার শাসনের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে পরিবর্তন আনার বিষয়টি উচ্চতর গুরুত্ব লাভ করে।

২২তম সংশোধনী: প্রয়োজনীয়তা এবং প্রণয়ন-
১৯৫১ সালে, ২২তম সংশোধনী প্রণীত হয়, যা সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে। এই সংশোধনী অনুযায়ী, একজন প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুটি চার বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হতে পারবেন, অর্থাৎ মোট ৮ বছর। তবে, যদি কোনও প্রেসিডেন্ট প্রথম মেয়াদের মধ্যে অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে টার্ম পূর্ণ করতে না পারেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এই সংশোধনীটির উদ্দেশ্য ছিল একাধিক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের সম্ভাবনা রোধ করা।

দুটি টার্মের সীমাবদ্ধতার কারণ-
২২তম সংশোধনীর প্রণয়নের প্রধান কারণ ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধ। এক ব্যক্তির দীর্ঘকালীন ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে। এছাড়া, গণতান্ত্রিক নবীনতা ও নেতৃত্বের সুযোগ নিশ্চিত করার জন্যও এই সীমাবদ্ধতা গুরুত্বপূর্ণ। নতুন নেতৃত্বের আগমন সরকারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতির প্রয়োগে সহায়তা করে, যা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গতিশীল ও কার্যকর রাখে। তদুপরি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণের জন্যও এটি জরুরি, কারণ দীর্ঘকালীন শাসন রাজনৈতিক পরিসরে স্থিতিশীলতার পরিবর্তে ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রভাব ও তুলনা-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সম্পর্কে নিয়মাবলী বিভিন্ন হতে পারে। ব্রিটেনে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট নয়, তবে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অন্যান্য দেশে দুটি মেয়াদ সীমাবদ্ধতার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণে সহায়ক। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম আন্তর্জাতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক।

২২তম সংশোধনীর প্রভাব-
২২তম সংশোধনী মার্কিন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এটি প্রেসিডেন্টদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করেছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। এই সীমাবদ্ধতা প্রেসিডেন্টদের ক্ষমতার পরিসর সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখে এবং নিশ্চিত করে যে নতুন নেতৃত্বের সম্ভাবনা অব্যাহত থাকে। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিবেশে এই সীমাবদ্ধতার প্রভাব নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি প্রবর্তনে সহায়ক হতে পারে, যা গণতন্ত্রের উন্নয়নে সাহায্য করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের দুটি টার্মের সীমাবদ্ধতা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার একটি মৌলিক অংশ। এটি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধ করে, নতুন নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে। ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের দীর্ঘকালীন শাসনের প্রেক্ষাপটে ২২তম সংশোধনী পাস হওয়ার সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রমাণ। এই সংশোধনী মার্কিন রাজনীতির গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রশাসনিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়তা করছে এবং গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখছে।

Tags

- Advertisement -