নতুন সংকটে ঢাকাই সিনেমা

ঢাকাই সিনেমা বা বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সাম্প্রতিক সংকট নতুন নয়, তবে বর্তমান পরিস্থিতি কিছু নতুন ও জটিল সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন ও বিতরণের সুরাহার জন্য বহু বছর ধরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে প্রতি নিয়তই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে বড় সংকটগুলির একটি হলো বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জ। এই শিল্পে শো-বক্স অফিসে লাভজনক চলচ্চিত্র প্রাপ্তির হার অনেক কমেছে। গত দশকজুড়ে বক্স অফিসে সফলতা অর্জন করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর কিছু কারণ:

বিভিন্ন স্ট্রিমিং সেবা: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন Netflix, Amazon Prime Video ইত্যাদি সমসাময়িক দর্শকদের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছে। দর্শকরা এখন সিনেমা হলে যাওয়ার পরিবর্তে ঘরে বসেই নতুন সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন।

বিষয়বস্তু এবং গুণমান:অধিকাংশ চলচ্চিত্রের গুণমান অত্যন্ত নিম্নমানের এবং পুনরাবৃত্তি বিষয়বস্তু নিয়েই নির্মিত হচ্ছে সিনেমা গুলি । এই কারণে দর্শকরা আকর্ষণ হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

অর্থনৈতিক অস্থিরতা: সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের ফলে সিনেমা দেখার জন্য দর্শকদের খরচ কমেছে, যা বক্স অফিসের আয়কে প্রভাবিত করেছে।

ঢাকাই সিনেমার আরেকটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে গুণমানের অবনতি। নির্মাতা, লেখক এবং অভিনেতাদের কিছু নতুন ও নৈপুণ্যপূর্ণ কাজ উপস্থাপন করা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের কাহিনি, স্ক্রীনপ্লে, এবং অভিনয়ের মান নিম্নমানের। আর এই সমস্যার পেছনে কিছু কারণও রয়েছে:

বিনিয়োগের অভাব: শিল্পের উন্নয়ন ও মান বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব রয়েছে আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে । ভালো মানের সিনেমার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট, প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাবও রয়েছে অনেক ।

প্রতিভার অভাব: নতুন পরিচালক এবং নির্মাতাদের অভাব রয়েছে এখানে। যারা আধুনিক দর্শকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হতে পারেন তাদের সংখ্যা নিতান্তই অল্প । পুরনো ধারণার ওপর নির্ভরশীলতা এবং সৃজনশীলতার অভাব গুণমানের অবনতি ঘটিয়েছে এই জগতের ।

নির্দেশনার অভাব: কার্যকরী নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপক অভাব রয়েছে, যা সিনেমার মান উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে।

তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের ফলে সিনেমা নির্মাণের প্রযুক্তিগত দিকেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু ঢাকাই সিনেমার প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সাধনে সমস্যা রয়েছে:-

প্রযুক্তির আপডেট: সিনেমা নির্মাণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এসব প্রযুক্তি আপডেট করা হয়নি এখনো এবং পুরনো প্রযুক্তির ওপরই নির্ভরশীলতা রয়েছে।

নির্মাণের মান:প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণের মান অনেক সময় নিম্নমানের হয়ে থাকে। যাতে  ক্যামেরা, এডিটিং সফটওয়্যার, এবং অন্যান্য প্রযুক্তির উন্নয়নের অভাব রয়েছে।

চলচ্চিত্রের সফলতা প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে বিতরণ এবং মার্কেটিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ঢাকাই সিনেমায় এই ক্ষেত্রগুলোতে কিছু সমস্যা বিদ্যমান:-

বিতরণ চ্যালেঞ্জ: চলচ্চিত্র বিতরণের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমাদের সঠিক বিতরণ নীতির অভাব এবং কার্যকর বিতরণ নেটওয়ার্কের অনেক অভাব রয়েছে।

মার্কেটিং পরিকল্পনা: অধিকাংশ সিনেমার মার্কেটিং পরিকল্পনা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তাই  সিনেমার প্রচারণা ও বিজ্ঞাপন পরিকল্পনায় যথেষ্ট উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে।

ঢাকাই সিনেমার ক্ষেত্রে আইনি এবং নীতিগত সমস্যায় নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে:

কপিরাইট সমস্যা: সিনেমার কপিরাইট সংক্রান্ত সমস্যাগুলি অনেক সময় চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে । কপিরাইট আইন প্রয়োগে অপ্রতুলতা এবং অব্যবস্থাপনাও লক্ষ্য করা যায় ।

অনুমোদন এবং সেন্সরশিপ: সিনেমার বিভিন্ন অংশে অনুমোদন ও সেন্সরশিপ সমস্যা রয়েছে। সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত এবং বাধার কারণে চলচ্চিত্রের মুক্তির ক্ষেত্রেও  বিলম্বিত হয়ে থাকে ।

ঢাকাই সিনেমার সম্মুখীন হওয়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এই চ্যালেঞ্জগুলোও উল্লেখযোগ্য:

দর্শকদের আগ্রহ পরিবর্তন: দর্শকদের আগ্রহ এবং পছন্দ পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত । পুরনো ধরনের সিনেমা নিয়ে তাদের আগ্রহ কমে গেছে এবং নতুন ধরণের বিষয়বস্তু নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন সবাই ।

সামাজিক প্রতিকূলতা: সিনেমার বিষয়বস্তু এবং পরিবেশের সাথে সামাজিক পরিবর্তন ও মূল্যবোধের অমিল ঘটছে প্রতিনিয়তই, যা চলচ্চিত্রের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রভাবিত করছে ব্যাপকভাবে ।

ঢাকাই সিনেমার সংকট কাটানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে যেমন:

বিনিয়োগ বৃদ্ধি: চলচ্চিত্র নির্মাণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা উচিত। এবং ভাল মানের সিনেমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট ও প্রযুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন: নির্মাতা ও শিল্পীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা জরুরী এবং নতুন প্রতিভা বিকাশের জন্য বিভিন্ন  পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

প্রযুক্তিগত আপগ্রেড: অবশ্যই সিনেমা নির্মাণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

মার্কেটিং ও বিতরণ উন্নয়ন: কার্যকর মার্কেটিং পরিকল্পনা এবং বিতরণ নেটওয়ার্ক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

আইনি সংস্কার: কপিরাইট আইন প্রয়োগে কার্যকর পদক্ষেপ এবং সেন্সরশিপ নীতির পর্যালোচনা করা দরকার।

পরিশেষে বলা যায়, ঢাকাই সিনেমার বর্তমান সংকটগুলি একটি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকটগুলি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন, এবং সুষ্ঠু মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমা আবারও তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারবে। শিল্পের প্রতি যথাযথ নজরদারি ও সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে, তাহলেই  এই সংকটগুলি মোকাবিলা করে নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করি।

Tags

- Advertisement -