পুঁজি-পাচার দেশের এক নাম্বার সমস্যা

অর্থনীতিবীদ মইনুল ইসলাম-

তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ । তিনি চট্টগ্রামের রাউজানে ১জুলাই ১৯৫০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও দ্বিতীয় বার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন এছাড়া ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে ১৯৭৩ সালে যোগ দেন এবং সেখান থেকেই তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে অবসর লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ইকোনমিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিইএ) এর সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইউজিসি অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি মনে করেন বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার। দেশ থেকে দেশের বাইরে অবৈধভাবে অর্থ- সম্পদ চলে যাওয়াকে পুঁজি পাচার বুঝায়।

অর্থনীতিবীদ মাইনুল ইসলাম প্রথম আলো পত্রিকার একটি কলামে লিখেছিলেন- বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার। পুঁজি পাচারের পুরোনো তিনটি প্রধান পদ্ধতি ছিল- আমদানি বাণিজ্যে ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপাতি ক্রয়। কিন্তু এখন এসব ছাড়িয়ে গেছে হুন্ডি পদ্ধতিতে পাঠানো প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা (প্রধানত ডলার) ক্রয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রধানত ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার। এই পদ্ধতিতে যেহেতু প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশেই হুন্ডিওয়ালার এজেন্টরা বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে বিদেশে রেখে দেন, তাই এই বৈদেশিক মুদ্রা (প্রধানত ডলার) দেশে আসে না।
দেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ অভিবাসীর অধিকাংশই এখন আর ফরমাল চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান না। হুন্ডিওয়ালাদের কাছে বেশি দাম পেয়ে তাঁদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক আয় হুন্ডিওয়ালাদের বিদেশি এজেন্টের কাছে তাঁরা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি ৭ মে, ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের কাছে ছেড়ে দেওয়ায় এক ডলারের দাম একলাফে ১১০ টাকা থেকে ১১৭ টাকায় নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে ডলার মার্কেটে হু হু করে এক ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে কয়েক দিনের মধ্যে ১২৭ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় ব্যাপারটা প্রমাণিত হয়েছে (বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউসের পক্ষ থেকে বাজার থেকে ডলার উধাও হয়ে যাওয়ার অভিযোগও শোনা যাচ্ছে)। আমার ভয় হচ্ছে, ডলারের দামের এই ক্রম-উল্লম্ফন বাংলাদেশ ব্যাংক সহজে থামাতে পারবে না।
তিনি আরো বলেন, পুঁজি পাচার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা; এই হুন্ডি কমাতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডলারের দাম তাঁদের কাছে কিছুই না। এখন অনেক ক্ষেত্রে ১৩০ টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানি করতে হচ্ছে। সরকার এসবের বিরুদ্ধে (অর্থ পাচার ও হুন্ডি) ব্যবস্থা নেয়নি, বরং পাচারের টাকা ফেরাতে কর ছাড়সহ নানা সুবিধা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক টাকাও দেশে ফেরেনি।

বণিক বার্তার সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, “‘বাংলাদেশের সিংহভাগ রেমিট্যান্স প্রেরকরা হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ ২১ বিলিয়ন ডলার যদি ফরমাল চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স আসে, তাহলে কমপক্ষে আরো ২১-২২ বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স (টাকার আকারে) হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে ঢুকছে।’ তিনি হুন্ডি পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার দমনে ব্যাংক খাতে সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি প্রয়োজনে ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন”।

তিনি আরো বলেন- ব্যাংকঋণের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকাই খেলাপি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা স্বীকার করে না। ব্যাংকঋণ শোধ করা হচ্ছে নতুন করে নেওয়া ঋণের টাকা দিয়ে। এক ঋণ সাত-আটবার পুনঃ তফসিল করা হচ্ছে। বাজারে গেলে মূল্যস্ফীতির শিকার হতে হয়। অন্য দেশ তা কমাতে পারলেও বাংলাদেশ পারেনি। অর্থনীতির এই দশা হয়েছে শাসকদের ভুলের কারণে।
তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদ্মা ব্যাংক করার টাকা কোথায় পেয়েছিলেন। বেসিক ব্যাংকের বাচ্চু (আব্দুল হাই) এখনো অধরা কেন। ন্যাশনাল ব্যাংককে নষ্ট করা সিকদারপুত্ররা কোথায়।

তাঁর এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন -‘রূপপুরের মতো প্রকল্প ভারতে অর্ধেক টাকায় করে দিয়েছে রাশিয়া। তাহলে কেন আমাদের বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। এমন অনেক অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে লুটপাট হচ্ছে। বড় অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো করে শ্রীলঙ্কা ধসে গেছে। আমরাও এমন খামখেয়ালি করে একই পথে চলছি।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা হলে প্রবাসী আয় বাড়বে। প্রবাসী আয় আমাদের অপার সম্ভাবনার জায়গা। এটিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। অর্থনীতির সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে মুখথুবড়ে পড়বে এ খাতটি। এদিকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘটনাগুলো আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে প্রবাসী আয় বাড়াতে। সাধারণ নাগরিকরা আর অর্থনৈতিক মন্দা ও শঙ্কায় থাকতে চান না। এ ব্যাপারে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

তিনি মনে করেন- হুন্ডি ব্যবসাকে দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনকে থামানো যাবে না, অর্থনীতি মহাবিপদে পড়বে।
এটি নিয়ে দৈনিক আজাদীর একটি কলামে অর্থনীতিবীদ মাইনুল ইসলাম প্রকাশ করেছিলেন যে- বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে আইএমএফ এর নিয়ম অনুযায়ী ২১.৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে । বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছিল যে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু আইএমএফ সরকারের ঐ দাবি সমর্থন করেনি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ঐ ঘোষিত রিজার্ভ থেকে রফতানি উন্নয়ন ফান্ডের (এক্সপোর্ট ডেভেলাপমেন্ট ফান্ড) মাধ্যমে প্রদত্ত সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। একইসাথে, বাংলাদেশ নিজেদের রিজার্ভ থেকে শ্রীলংকাকে যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে তা–ও বাদ দিতে হবে।

আরো বাদ দিতে হবে রিজার্ভ থেকে পায়রা বন্দরের বামনাবাদ চ্যানেল খননের জন্য এবং বাংলাদেশ বিমানকে বিমান কেনার জন্য যে ঋণ দেওয়া হয়েছে সে অর্থও। এটা খুবই দুঃখজনক যে দীর্ঘ প্রায় দু’বছর বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব আইএমএফ এর এসব আপত্তির ধার ধারেনি। এখন যখন বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে তখন বাধ্য হয়ে ঐ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার শর্ত পূরণের উদ্দেশ্যে গত জুলাই মাসে রিজার্ভ হিসাব করার সর্বশেষ পদ্ধতি বিপিএম–৬ মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুরানো বিপিএম–৫ পদ্ধতি অনুসরণে যে ‘ইনফ্লেটেড বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ’ দেখানোর খামখেয়ালিপনায় পেয়ে বসেছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে, তার ফলে গত দু’বছরে বেশ কয়েকটি অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সরকার। সবচেয়ে ক্ষতিকর সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে এক্সপোর্ট ডেভেলাপমেন্ট ফান্ড গঠন করে ব্যবসায়ীদেরকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত। ইতোমধ্যেই এই ঋণগুলোর সিংহভাগই ‘ফোর্সড লোনে’ পরিণত হয়েছে। এর মানে, এই ঋণগুলো আর কখনোই বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত আসবে না। এর বেশিরভাগই স্রেফ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে ঋণগ্রহীতা রফতানিকারকরা। আরো দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের বেশিরভাগ ‘খেলাপি ঋণে’ পরিণত হয়ে গেছে। এর মানে হলো, বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদত্ত রিজার্ভের এই বিরাট অংশটি পুরোপুরি লুন্ঠিত হয়ে গেছে। রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ যে অনেক কম তা উপলব্ধি করতে পারলে হয়তো এই অপ্রয়োজনীয় কর্মসূচিটি নেয়া হতো না! প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করলে পায়রা বন্দরের চ্যানেলের খননকাজ এবং বাংলাদেশ বিমানের বিমান কেনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের ঋণ দেওয়ার কোন যুক্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ২০২০ এবং ২০২১ সালের পত্র–পত্রিকার খবরগুলো পড়লে বোঝা যাবে, ঐ সময় সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব বারবারই বক্তব্য রাখছিল যে বাংলাদেশ খামোকা এতবড় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, যেহেতু মার্কিন রিজার্ভ সিস্টেমে এই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখলে সেখান থেকে অতি সামান্য সুদ পাওয়া যায় তাই ঐ রিজার্ভের অর্থ দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করলে সুদও বেশি পাওয়া যাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সক্ষমতাও বাড়বে সরকারের। ২০২০ সালে যখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ বেড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এহেন খায়েস পত্র–পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছিল। তখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এহেন ধারণা ছিলো যে, অযৌক্তিক তা ব্যাখ্যা করে পত্র–পত্রিকায় কলাম লিখেছি, কিন্তু কে শোনে ওসব কথা? ২০২০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক বণিক বার্তা এবং দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার কলাম থেকে নিচের উদ্ধৃতিগুলো তুলে ধরছি, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্ফীতির আসল গুরুত্ব হলো এটি একটি দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা ও শক্তির প্রতীক। কোন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন ক্রমবর্ধমান থাকে তখন ঐ অর্থনীতির নীতি–প্রণেতাদেরকে কারো ব্ল্যাকমেইলের তোয়াক্কা করতে হয় না।’

নীতিগ্রহণের এই সার্বভৌমত্বের মূল্য অপরিসীম, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে—যে কোন দেশের অর্থনীতির দুর্বলতা এবং শক্তির ‘এসিড টেস্ট’ হলো লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টের ঘাটতি বনাম উদ্বৃত্তের অবস্থান। বাংলাদেশের দৃশ্যমান রফতানি ও আমদানির প্রবাহের ‘ব্যালেন্স অব ট্রেডে’ এখনো প্রায় বছর পনেরো থেকে কুড়ি বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, যখন থেকে আমরা প্রধানত ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহের সহায়তায় ঐ ঘাটতি মেটাতে সক্ষম হচ্ছি তখন থেকে বৈদেশিক ঋণ–অনুদানের জন্যে আমাদেরকে আর বিদেশী রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার দয়া–দাক্ষিণ্যের উপর অতি–নির্ভরশীল হতে হচ্ছে না—এই পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিনীত অনুরোধ করেছিলাম – ‘এখনই রিজার্ভে হাত দেবেন না, প্লীজ! রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান করার চিন্তাকে এখনো সময়োপযোগী বলা যাচ্ছে না’। বলা বাহুল্য, আমার ঐ সময়োচিত সাবধান বাণীকে পাত্তা দেননি সাবেক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর চাইতে যে আমার জ্ঞান কম হওয়ার কোন কারণ নেই সেটা তাঁকে বোঝাতে যাবে কে? আমি তাঁর এহেন খামখেয়ালি প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে আপত্তি জানানোয় তিনি ব্যঙ্গ করে আমাকে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের মে মাসে জার্মান টিভি ডয়শে ভেলে আমাকে এ–ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলায় আমি বলেছিলাম,‘২০১২ সালে যখন বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করেছিল তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমিই প্রথম তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলাম নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য। আবার, তাঁর হাত থেকেই আমি ‘একুশে পদক’ নিয়েছি। এখন তিনি আমাকে অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ বলছেন! তা তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু আমি আমার অবস্থান বদলাবো না’। আমার এই সাবধান বাণীকে আমলে না নেয়ার ফলে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সামাল দিতে সরকারকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। দুই বছরে দেশের ‘গ্রস রিজার্ভ’ কমে এখন ২১.৭১ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের ‘নীট রিজার্ভ’ এখন ১৯ বিলিয়ন ডলারেরও কম। রিজার্ভের এহেন পতনের ধারাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলতেই হবে। গ্রস রিজার্ভকে কুড়ি বিলিয়ন ডলারের নিচে নামতে দেওয়া যাবে না, নইলে অর্থনীতি মহাবিপদে পড়বে। কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত আগস্টে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আগের বছরের আগস্টের চাইতে ২১ শতাংশ কমে গেছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম পনেরো দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৭৪ কোটি ডলার, তার মানে এই ধারা বজায় থাকলে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স ১৫০ কোটি টাকার বেশি হবে না। অথচ, গত বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬০ কোটি ডলার। যখন দুই বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে তখনো সাবেক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উচ্চকন্ঠে বলেছেন রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছুই নেই, আমাদের নাকি প্রায় ছয় মাসের আমদানি বিল পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। এখন আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রকৃতপক্ষে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত। আইএমএফ তাদের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার শর্ত দিয়েছে যে ২০২৩ সালের জুন মাসের শেষে দেশের নীট রিজার্ভকে ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা এই টার্গেট থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে আছি। দেশের দেড় কোটির বেশি মানুষ বিদেশে কর্মরত থাকলেও তাঁদের অধিকাংশই হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই এই সমস্যার সমাধান মিলবে না, কারণ হুন্ডি ডলারের চাহিদা কাঠামো শক্তিশালী থাকলে বাজারে ডলারের দাম যতই থাকুক হুন্ডি পদ্ধতিতে ডলারের দাম তার চাইতে ৭/৮ টাকা বেশি পাওয়া যাবেই। দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারকারীরাই এই হুন্ডি ডলারের চাহিদাকে শক্তিশালী রাখছে, যেজন্য দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে  বিদেশে আর তাই  পুঁজিপাচার এখন দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছে।(সংগৃহীত)

Tags

- Advertisement -