অন্বেষণা অনন্যা বুদ্ধিজীবী রেমিলা থাপার

বুদ্ধিজীবী মহলে প্রখ্যাত নামগুলোর মধ্যে একজন হলেন রেমিলা থাপার। ইতিহাসের সিংহদ্বার খোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ভারতীয় ইতিহাসের ওপর তাঁর গভীর বিশ্লেষণ এবং বৈচিত্র্যময় গবেষণা তাঁকে একটি অনন্য স্থান এনে দিয়েছে।

রেমিলা থাপার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালে, লাহোরে, যা বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ও বাল্যকাল লাহোরেই কাটে। দেশভাগের পর পরিবার কলকাতায় চলে আসে এবং সেখানে তাঁর শিক্ষাজীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর, থাপার স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনের সোসাইটি অফ অ্যান্টিকুইটিজে উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য যান।

লন্ডনে থাকাকালীন থাপার ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে গভীর গবেষণা করেন এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদদের সাথে আলাপচারিতা করেন। তাঁর গবেষণা এবং শিক্ষাজীবন তাকে ভারতীয় ইতিহাসের প্রতি গভীর আকর্ষণ জাগিয়ে তোলে। এই সময় তিনি ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিভিন্ন অজানা দিক সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর কর্মজীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

রেমিলা থাপারের গবেষণা ও সাহিত্যিক কাজ ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ‘অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া: কালচার ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট’ (Ancient India: Culture and Social Development)। এই বইটি প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন বিশ্লেষণ করে, যা ইতিহাসবিদদের কাছে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

‘অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে থাপার প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন দিক উন্মোচন করেন। তিনি সামাজিক শ্রেণীবিভাজন, রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের নানা দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। এই কাজের মাধ্যমে, তিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের নতুন দৃষ্টিকোণ প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীতে ইতিহাসবিদদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

তারপর, ‘আনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন’ (Ancient India: An Introduction) গ্রন্থে, থাপার ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীন যুগের আরো বিস্তারিত ও সমন্বিত বিশ্লেষণ প্রদান করেন। এখানে তিনি বিশেষভাবে গৌতম বুদ্ধ এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন নিয়ে আলোচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসমূলক পরিসর গড়ে তোলেন।

রেমিলা থাপার এর গবেষণার মূলক বৈশিষ্ট্য হলো তার আন্তঃবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি ইতিহাসের বিভিন্ন দিকের সাথে সমাজবিজ্ঞান, সংস্কৃতিশাস্ত্র, এবং অর্থনীতির সম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁর বিশ্লেষণ প্রণালী অতীতের ঐতিহাসিক ঘটনার নানা দিক থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় নিয়ে ঘটে।

একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো থাপারের প্রতিকূলতায় ধৈর্য এবং তার গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি গভীর মনোযোগী। তিনি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার বিভিন্ন দিক এবং তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে অত্যন্ত সাবলীলভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে অন্যান্য ইতিহাসবিদদের থেকে আলাদা করে তোলে।

রেমিলা থাপারের কাজ শুধু ভারতীয় সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। তাঁর গবেষণা এবং প্রকাশনার জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তাঁর বইগুলি বিশ্বজুড়ে ইতিহাসবিদ, গবেষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

‘দি প্যাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট: দ্য রাইজ অফ ইন্ডিয়া’ (The Past and Present: The Rise of India) গ্রন্থটি একটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছে। এই গ্রন্থে, থাপার ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাচীন সময় থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন। বইটি একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রদান করে এবং ভারতীয় ইতিহাসের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

বুদ্ধিজীবী জীবনের সাথে সাথে, রেমিলা থাপার একটি স্বচ্ছল ও মানবিক জীবনও যাপন করেছেন। তিনি তাঁর কর্মজীবনে নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও তাঁর পেশাগত জীবনের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলেছে, এবং তিনি একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে জীবনযাপন করেছেন।

অবসরের পর, থাপার একটি প্রফেসর এমেরিটাস হিসেবে কাজ করেছেন এবং তাঁর গবেষণার অভিজ্ঞতা তরুণ ইতিহাসবিদদের সাথে ভাগ করেছেন। তাঁর অবসরের পর, তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা অব্যাহত রয়েছে এবং তা নতুন প্রজন্মের ইতিহাসবিদদের জন্য একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে।

রেমিলা থাপার একজন প্রভাবশালী ইতিহাসবিদ, যাঁর কাজ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক উন্মোচন করেছে। তাঁর গবেষণা ও সাহিত্যিক অবদান ভারতীয় ইতিহাসের মূলে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তাঁর চিন্তাভাবনা এবং বিশ্লেষণ অন্যান্য গবেষকদের জন্য একটি মৌলিক রূপরেখা সরবরাহ করেছে। থাপারের কাজ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং তাঁর জীবন ও গবেষণা আমাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে রয়ে যাবে।

Tags

- Advertisement -