রবীন্দ্রনাথকে লেখা নজরুলের চিঠি

রবীন্দ্রনাথের উপর লেখা নজরুলের অনেকগুলি কবিতা পাওয়া গেলেও রবীন্দ্রনাথকে লেখা নজরুলের একটি মাত্র পুরা চিঠিই পাওয়া গেছে। সেই চিঠিটি লেখার ইতিহাস হ’ল-

নজরুল এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে ১৯৩৪ সালে ‘নাগরিক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো কলকাতার ১সি মন্মথ ভট্টাচার্য স্ট্রীট থেকে। এই পত্রিকার ২য় বর্ষের অর্থাৎ ১৯৩৫ সালের পূজা সংখ্যার জন্য নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি লেখা চেয়ে এই চিঠিটি লিখেছিলেন। নজরুলের লেখা চিঠিতে তারিখ ছিল – ২৮শে আগস্ট ১৯৩৫।

রবীন্দ্রনাথকে লেখা নজরুলের সেই চিঠিটি,-

শ্রীচরণারবিন্দেষু,

গুরুদেব! বহুদিন শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর হয়ত প্রসন্ন কাব্য-লক্ষ্মী হিজ মাস্টার্স-ভয়েসের কুকুরের ভয়ে আমায় ত্যাগ করেছেন বহু দিন। কাজেই সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি। আপনার তপস্যায় আমি কখনো উৎপাত করেছি বলে মনে পড়ে না, তাই অবকাশ সত্ত্বেও আমি আপনার দূরে দূরেই থেকেছি। তবু জানি আমার শ্রদ্ধার শতদল আপনার চরণস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি। আমার কয়েকজন অন্তরঙ্গ সাহিত্যিক ও কবি বন্ধু ‘নাগরিক’ পরিচালনা করছেন। গতবার পূজায় আপনার কিরণস্পর্শে ‘নাগরিক’ আলোকিত হয়ে উঠেছিল, এবারও আমরা সেই সাহসে আপনার দ্বারস্থ হচ্ছি।আপনার যে-কোনো লেখা পেলেই ধন্য হব। ভাদ্রের শেষেই পূজা সংখ্যা ‘নাগরিক’ প্রকাশিত হবে, তার আগেই আপনার লেখনীপ্রসাদ আমরা পাবো আশা করি।

আপনার স্বাস্থ্যের কথা আর জিজ্ঞাসা করলাম না।

ইতি – প্ৰণত

নজরুল ইসলাম

নজরুলের এই চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩৫-এর ১লা সেপ্টেম্বর নজরুলের কলকাতার ঠিকানায়, এই চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন।

কল্যাণীয়েষু,

অনেকদিন পরে তোমার সাড়া পেয়ে মন খুব খুসী হ’ল।, কিছু দাবী করেছ — তোমার দাবী অস্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন। আমার মুস্কিল এই, পঁচাত্তরে পড়তে তোমার অনেক দেরি আছে। সেইজন্য আমার শীর্ণশক্তি ও জীর্ণদেহের ‘পরে তোমার দরদ নেই। কোনো মন্ত্রবলে বয়স বদল করতে পারলে তোমার শিক্ষা হোতো। কিন্তু মহাভারতের যুগ অনেক দূরে চলে গেছে। এখন দেহে, মনে মানব সমাজকে চলতে হয় সায়েন্সের সীমানা বাঁচিয়ে।অনেকদিন থেকে আমার আয়ুর ক্ষেত্রে ক্লান্তির ছায়া ঘনিয়ে আসছিল, কিছুদিন থেকে তার উপরও দেহযন্ত্রের বিকলতা দেখা দিয়েছে। এখন মূলধন ভেঙে দেহযাত্রা নির্বাহ করতে হচ্ছে, যা ব্যয় হচ্ছে তা আর পূরণ হবার নেই।তোমাদের বয়সে লেখা সম্বন্ধে প্রায় দাতাকর্ণ ছিলুম, ছোটোবড়ো সকলকে অন্ততঃ মুষ্ঠি ভিক্ষাও দিয়েছি। কলম এখন কৃপণ, স্বভাবদোষে নয়, অভাববশতঃ । ছোটো বড়ো নানা আয়তনের কাগজের পত্রপুট নিয়ে নানা অর্থী আমার অঙ্গনে এসে ভিড় করে। প্রায় সকলকে ফেরাতে হলো। আমার অনাবৃষ্টির কুয়োর শেষতলায় অল্প যেটুকু জল জমেছিল, সেটুকু নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি কৃপণের অখ্যাতি শেষ বয়সে স্বীকার করে নিয়ে রিক্ত দানপাত্র হাতে নিয়ে বিদায় নেব। যারা ফিরে যাবে, তারা দুয়ো দিয়ে যাবে, কিন্তু বৈতরণীর মাঝ দরিয়ায় সে ধ্বনি কানে উঠবে না।আজকাল দেখতে পাই ছোটো ছোটো বিস্তর কাগজের অকস্মাৎ উদ্‌গম হচ্ছে ফুল ফসলের চেয়ে তাদের কাঁটার প্রাধান্যই বেশি। আমি সেকেলে লোক, বয়সও হয়েছে। সাহিত্যে পরস্পর খোঁচাখুঁচির প্রাদুর্ভাব কেবল দুঃখকর নয়, আমার কাছে লজ্জাজনক বোধ হয়।এই জন্যে এখানকার ক্ষণসাহিত্যের কাঁচা রাস্তায় যেখানে সেখানে পা বাড়াতে আমার ভয় লাগে। সাবধানে বাছাই করে চলবার সময় নেই, নজরও ক্ষীণ হয়েছে, এইজন্যে এই সকল গলিপথ এড়িয়ে চলাই আমার পক্ষে নিরাপদ। তুমি ভরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছ থেকে আর কিছু না হোক, করুণা দাবী করতে পারে। অঙ্কিঞ্চনের কাছে প্রার্থনা ক’রে তাকে লজ্জা দিয়ো না। এই নতুন যুগে যে সব যাত্রী সাহিত্যতীর্থে যাত্রা করবে, পাথেয় তাদের নিজের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করতে হবে।শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি তার পাশের জিলায় যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের দিকে আসতে পারো খুসী হব। স্বচক্ষে আমার অবস্থাও দেখে যেতে পারবে।

ইতি- স্নেহরত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৫ ভাদ্র ১৩৪২

 

নজরুল এই চিঠি পেয়ে খুবই অভিভূত হয়ে পড়েন এবং ‘তীর্থ পথিক’ নামক একটি কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের পত্রের উত্তর দেন।

‘তীর্থ পথিক’

পথিক! তুমি কে? কী করে আসিলে?

তোমার চোখে কি কোন রহস্যের দৃষ্টি আছে?

মৃত্যুর সনাতন সেই প্রার্থনার কথা বলো;

মনে করে কি তৃষ্ণা, হায়! বুকের হাহাকার?

তুমি কি জানো? তুমি হে পথিক!

এক কালের অতল হিমাচলে,

তীর্থের পথে কীর্তন গেয়ে

মৃত্যুর গুহায় চেয়ে আছো; তুমি কি জানো?

তোমার শীতল কল্যাণ,

মৃত্যুর সান্নিধ্যে দীপশিখার দীপালোক;

যতদিন বাঁধবে না কীর্তন,

ততদিন তুমি চলে যেও, যেখানেই যাও!

আমি পথিক, আমি কি তোমার অশ্রুর কথা বলবো?

তুমি হে পথিক, কত পথ ঘুরে এলে!

তোমার তীর্থের মত অতল গহ্বরে চলে যাও,

তবুও তুমি আমার অনন্ত যাত্রার প্রাপ্তি।

Tags

- Advertisement -