জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর চাপ কমাতে ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশের গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোয় বিভিন্ন কোর্সে অধ্যয়ন করেন ২৮ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। এটি দেশের সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়ের অধীনে পড়াশুনা করে। অথচ তাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২ হাজার ২৫৭টি কলেজে প্রায় ৩১ লক্ষ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী যা দেশে উচ্চ্ শিক্ষার মোট শিক্ষার্থীর ৭২ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি কলেজ ৫৫৫টি এবং ৩৩১টি বেসরকারী কলেজ অর্থাৎ ৮৮১টি কলেজে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর পাঠদান করা হয়। এসব কলেজে পড়াশুনার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। একটি সম্মান ক্লাসে শিক্ষক ও ছাত্রের যে অনুপাত থাকা উচিৎ সে অনুপাতের ধারেও নেই কলেজগুলো। একটি সরকারী কলেজে মানবিক ও কলা অনুষদের বিষয়ভিত্তিক ছাত্রসংখ্যা ৩০০ থেকে ৩৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে শিক্ষকের সঙ্গে কোনোভবেই যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না।

জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন কলেজে যত্রতত্র অনার্স কোর্স খুলে দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষাকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এসব কলেজে নেই ভালো শিক্ষক নেই পর্যাপ্ত বইপুস্তক। লাইব্রেরির কোনো সুযোগ সুবিধা না থাকায় গাইড নির্ভর পড়াশোনা শিক্ষাকে পণ্য করে তুলেছে। মৌখিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে বই এর নাম জিঙ্গেস করলে গাইডের নাম বলে। ইংরেজি বই এর নাম কোনো দিন তারা শুনে না। এই যদি হয় অনার্স শ্রেণির অবস্থা তাহলে ডিগ্রি ক্লাসের ছেলেমেয়েদের অবস্থা ভাবুন। তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্সের যে পরিমাণ ক্লাস হওয়ার কথা তার এক-চতুর্থাংশ হয় কি না সন্দেহ। বিজ্ঞান (বিএসসি) ও বাণিজ্য (বিবিএ) গ্রুপের ছাত্রছাত্রীরা কিছু ক্লাস করে গণিত এবং ল্যাব থাকার কারণে। মূলত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা গ্রহণ আর সনদ বিতরণ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। বিজ্ঞান অনুষদে ১৮০ থেকে ২০০ জন পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। ফলে বিজ্ঞানের ল্যাব ও হাতে কলমে শিক্ষার মান বজায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।

বিষয় ভিত্তিক ক্রেডিট (ঘণ্টা) আওয়ার ক্লাসের যে মান নির্ধারণ করা আছে, সে বিষয়ে অনেক শিক্ষকই জানেন না কতটা ক্লাস তাকে নিতে হবে। তিন ক্রেডিটের একটি বিষয়ে কমপক্ষে ৪২টি ক্লাস নিতে হয়। সে অনুযায়ী সপ্তাহে একটি বিষয়ে ৩টি ক্লাস নিলেও ৪ মাস ক্লাস নেওয়া আবশ্যক। ইচ্ছে থাকলেও কলেজের শিক্ষকরা এ মান বজায় রাখতে পারেন না। কারণ একজন শিক্ষক ৪ থেকে ৫টি বিষয়ের ক্লাস নেন প্রতিদিন ফলে সপ্তাহে ১২ থেকে ১৫ টি ক্লাস নিতে হয়। সরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকস্বল্পতার চিত্রও উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম ১ জন শিক্ষক থাকতে হবে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ধারে-কাছেও নেই। এসব কলেজে ৯১ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র একজন শিক্ষক রয়েছেন। আবার বেসরকারি কলেজগুলোতে গড়ে ২৫ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন।

যেখানে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি সেমিস্টারে ২টি আর ৪ বছর মেয়াদি অনার্স শেষ করতে ১৬টি প্রেজেন্টেশন দিতে হয়, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত একবারও প্রেজেন্টেশন দিতে হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে প্রতি সেমিস্টার শেষে অন্তত একটি করে ৪ বছরে মোট ৮টি ভাইভা দিতে হয়, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইভা দিতে হয় মাত্র একটি। তাও আবার নামমাত্র, অনেকটা নিয়ম রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি অভিজ্ঞতার জন্য গ্রাজুয়েশন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা থাকে। তাছাড়া ফিল্ড ভিজিট, বিজনেস কোর্স কম্পিটিশন, রিসার্চ, এসাইনমেন্ট ইত্যাদির মতো কার্যক্রম চলতে থাকে সবসময়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এর কোনো ছিটেফোঁটাও নেই।জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থ প্রশ্ন-উত্তর পড়া নিয়ে ব্যস্ত।

বগুড়া আজিজুল হক সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান নাঈম একটি কলামে লিখেছেন –

“এবার শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি প্রসঙ্গে বলতে চাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলে প্রথমে মাথায় আসে-‘ওহ! ওখানে তো ক্লাস করা লাগে না।’ আসলেও তা-ই। ইনকোর্স পরীক্ষায় ক্লাসে উপস্থিতিতে ৫ নম্বর নির্ধারিত থাকলেও খুব একটা কার্যকর হয় না সেটিও। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর অনার্স থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষাজীবন কাটে শুধু ওই ইনকোর্স আর ফাইনাল পরীক্ষায় উপস্থিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। যদিও বা কোনো ভালো শিক্ষার্থী ক্লাস করতে যায়, গিয়ে দেখে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র শিক্ষার্থী ক্লাসে এসেছে। তাই শিক্ষকও সেভাবে পড়াতে আগ্রহবোধ করেন না। ফলে সময় কাটে মোটিভেশন দিয়ে আর গল্পে গল্পে। এভাবে যখন কেটে যায় গোটা একটি শিক্ষাবর্ষ, রুটিন প্রকাশ হয় নির্বাচনি পরীক্ষার। এ পরীক্ষা যেন রহস্যের আরেক নাম। প্রশ্নপত্র দেওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের সাদা খাতায় শুধু নাম-রোল লিখে জমা দেওয়ার পালা। কিছুক্ষণ পর থেকে শিক্ষকরাও যেন ইশারা-ইঙ্গিতে বলতে থাকেন, ‘খাতা জমা দাও’। পরীক্ষা দেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থী যখন দেখতে পায় অন্য সবাই খাতা জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন তার মানসিকতার পরিবর্তন কি স্বাভাবিক নয়? তাহলে দায় কার? দায় কর্তৃপক্ষের। কারণ শিক্ষার্থীরা নিশ্চিতভাবেই জানে, তাদের নির্বাচনি পরীক্ষার খাতা দেখাও হবে না, মূল্যায়নও হবে না। তাহলে পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ? দেশের তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে চায়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে তরুণরা যেন চাকরির বাজারে অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে এটুকুই প্রত্যাশা করি”।

সেশনজট নামক এই মহা অভিশাপের কারণে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলছেন লেখাপড়া করার ইচ্ছা। তরুণদের দিয়ে পরিচালিত একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ বলছে, করোনায় ১৯ মাসে সারা দেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছেন তরুণ-তরুণী।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেছিলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি তার পরিবারকে দেখাশোনাসহ বিভিন্ন কাজে লিপ্ত থাকে। উচ্চ শিক্ষার মান কমিয়ে তাদের কারিগরি দিকে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। যারা বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে, তাদের এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত।

তিনি বণিক বার্তার একটি কলামে আরো বলেছিলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য রয়েছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও সে শ্রেণীবিভাজনমুক্ত নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী বেশি- এটাই বাস্তবতা। কারণ তারা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ পাচ্ছে না। সত্যিকারার্থে পাবলিকে ভর্তির জন্য প্রস্তুত হতে যে সুযোগ-সুবিধা দরকার, হয়তো তারা তা থেকেই বঞ্চিত। আমরা এ সমস্যাকে অস্বীকার করছি না। তবে শুধু সমস্যা নিয়ে আলোচনা না করে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। আমরা সেটাই করেছি।’

দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য শুরু হয়। অর্থাভাবে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ হয় না নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। পরিবার খরচ চালাতে না পারায় যাওয়া হয় না কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউশনে। এ কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটাই দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শেষ পর্যায়ে দরিদ্র পরিবারের খুব কম শিক্ষার্থীরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মেলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় উচ্চশিক্ষাপ্রার্থী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, পাহাড়-সমতল এমন নানা বৈষম্য বিরাজ করছে অনেক আগে থেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অসুস্থ কিছু প্রতিযোগিতা এ অসমতা আরো বহুগুণ বাড়িয়েছে। বৈষম্যের শিকার হয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা যেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে। পড়তে আসার পরও কলেজে গিয়ে তারা ফের বৈষম্যের মুখোমুখি হয়। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম মানদণ্ডও অনুসরণ করা হয় না।  শ্রেণীকক্ষের পাঠদান ঠিকমতো নিশ্চিত করা হচ্ছে না।’

আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ মন্তব্য করেন যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নিতে হবে। পূর্বের ন্যায় প্রতিটি কলেজে শিক্ষার পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে হবে। একাডেমি বর্ষ ছোট করে সিলেবাস কমিয়ে হলেও শিক্ষার্থীদের হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো পুষিয়ে নিতে হবে এবং দ্রুত পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করতে হবে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পূর্বের ন্যায় ক্রাশ প্রোগ্রাম ব্যবস্থা করে দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা চাই- “সেশনজটমুক্ত হোক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জ্ঞানের প্রবাহ হোক বাধাহীন”।

Tags

- Advertisement -