বাংলাদেশের বিচার প্রশাসনে ব্যবস্থা বা পদ্ধতিগত Systemic পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

ড. এম. শাহ আলম

বাংলাদেশের বিচার প্রশাসনে গতিশীলতা এনে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ও মামলার জট হ্রাস করার লক্ষ্যে ন্যায়বিচারের মান ক্ষুন্ন না করে কোন ব্যবস্থা বা কাঠামোগত পরিবর্তন আনা যায় কি-না সে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক প্রতিয়মান হয়। বিশ্বে মূলতঃ দুই ধরণের আইন ব্যবস্থা রয়েছে। একটি হচ্ছে কমন ল’ যা ইংল্যান্ড ও তার প্রাক্তন উপনিবেশে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসমূহে বিদ্যমান, এবং আরেকটি হচ্ছে সিভিল ল’ যা ইংল্যান্ড ব্যতিরেকে পুরো ইউরোপ, এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় তার প্রক্তন উপনিবেশে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসমূহে বিদ্যমান রয়েছে। বৈশিষ্ট ও প্রকৃতগত কারণে কমন ল’ কে Adversarial (দ্বন্দ্বমূলক) এবং সিভিল ল’ কে Inquisitorial (অনুসন্ধানমূলক) বিচার ব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়। এটা স্বীকৃত সত্য যে, সিভিল ল’ ব্যবস্থায় বিচার প্রক্রিয়া অধিকতর গতিশীল, যার ফলে সিভিল ল’ রাষ্ট্রসমূহে মামলার দীর্ঘ সূত্রতা ও জট অপেক্ষাকৃত কম। কাজেই সঙ্গত করণেই প্রশ্ন উঠেছে সিভিল ল’ রাষ্ট্রসমূহের অভিজ্ঞতা, তাদের ব্যবস্থার কোন উপাদান কমন ল’ ব্যবস্থায় ব্যবহার করে লাভবান হওয়া যায় কি-না। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে এ নিয়ে চিন্তা করছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সিভিল ল’ এর অভিজ্ঞতা ও উপাদান সফলভাবে প্রয়োগ করছে। সময় এসেছে আমাদেরও এ নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা ভাবনা করার। দুই ব্যবস্থারই মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধীয় ঘটনা ও তথ্যের সত্যতা নিরূপন ও উপযুক্ত আইন প্রয়োগ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের পদ্ধতি ও পথ ভিন্নতর। লক্ষ্য এক বলেই দুই ব্যবস্থা পারষ্পরিক গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে।

কমন ল’ ব্যবস্থায় মামলার দুই পক্ষের মধ্যে মৌখিক যুক্তি-তর্ক, সওয়াল-জওয়াব, জেরাকরণের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এখানে পক্ষদ্বয় বা পক্ষসমূহের আইনজীবীবৃন্দের বক্তব্য উপস্থপনা, তাঁদের আইনের জ্ঞান, পান্ডিত্য, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি মামলার ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করে। তাদের বক্তব্য, যুক্তি পেশ, সাক্ষী প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য অধিকতর সময় আবেদন করার সুযোগ বেশি। আইনজীবীগণ সক্রিয় ও উদ্যোগী এবং দুই পক্ষের যুক্তি-তর্ক দ্বন্দ্বমূলকভাবে অগ্রসর হয়। দাখিলকৃত দলিল দস্তাবেদ গুরুত্বপূর্ণ হলেও আইনজীবীদের মৌখিক উপস্থানপাই প্রাধান্য পায়। কমন ল’ তে ঐতিহাসিকভাবে এবং আইনে Procedural Fairness (পদ্ধতিগত ন্যায্যতা) এর উপর বেশি জোর দেয়া হয়। মনে করা হয় সত্য উদ্‌ঘাটনে ও ন্যায়বিচারের জন্য এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দেওয়ানী ও ফৌজদারী কার্যবিধিতে এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। আইনজীবীগণ সব সময়ই এর সুযোগ গ্রহণে সচেষ্ট থাকেন। এটি মামলার দীর্ঘ সূত্রতার একটি বড় কারণ।

কমন ল’ ব্যবস্থায় বিচারকবৃন্দ মামলা পরিচালনায় যথেষ্ট সক্রিয় ও উদ্যোগী নন। তারা মামলা পরিচালনা ও রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অবস্থান, বক্তব্য, যুক্তি, সাক্ষী প্রমাণ প্রদর্শনের উপরই বেশি নির্ভর করেন, এবং অনেকটা রেফারীর ভূমিকাই পালন করেন। আইনজীবীদের বক্তব্য, সাওয়াল-জওয়াব ও সাক্ষী প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য সময় আবেদন মঞ্জুরকরণে প্রয়াস অতি উদারতা প্রদর্শন করেন। তারা সাধারণত নিজস্ব উপায়ে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ বা কোন বিষয়ের সত্যতা যাচাইয়ে উদ্যোগ গ্রহণ না করে এর জন্য পক্ষসমূহের আইনজীবীদের উপরই নির্ভর করেন।

অন্যদিকে সিভিল ল’ এর অনুসন্ধানমূলক (Inquisitorial) পদ্ধতিতে বিচারকগণ অধিকতর সক্রিয়, উদ্যোগী এবং আইনজীবীদের বক্তব্য, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে সময় আবেদন মঞ্জুরে অধিকতর সতর্ক ও নিয়ন্ত্রণী। তারা বিচারকার্য পরিচালনা ও রায় প্রদানে শুধু আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক ও উপস্থাপিত সাক্ষী প্রমাণের উপর নির্ভর করেন না, নিজেরাও সত্য সন্ধানের জন্য নিজস্ব পদ্ধতিতে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করতে পারেন। তারা পক্ষগণ কর্তৃক দাখিলকৃত দলিল-দস্তাবেজের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন।

আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক ও বক্তব্য সত্য নিরূপনে শুধু সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিাচরকগণ প্রয়োজনে পক্ষদের সঙ্গে আলাদা বা যৌথভাবে বসে মামলা নিয়ে আলোচনা করে বিষয়সমূহ চিহ্নিতকরণ, নিদিষ্টকরণ ও narrow down করেন। এটা মামলা ব্যবস্থাপনা (case management) এর জন্য জরুরি। এই পন্থায় ADR-এর পথও সুগম হয়।

সিভিল ল’ তে আইনজীবীগণ স্ব স্ব মক্কেলের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকলেও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন কালে তারা দ্বন্দ্বমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন না। তারা বক্তব্য প্রদান ও সাক্ষী প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বেশি সময় নেন না বা নিতে পারেন না। তারা আদালতের সঙ্গে একটি অনুসন্ধানী সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯৬ সনে লর্ড উলফের প্রতিবেদনে, যার ভিত্তিতে ইংলেন্ডে নতুন দেওয়ানী কার্যবিধি প্রণীত হয়েছে, কিভাবে কমন ল’ এর দ্বন্দ্বমূলক ব্যবস্থা সিভিল ল’ এর অনুসন্ধানমূলক পদ্ধতির অনেক উপাদান লাভজনকভাবে গ্রহণ করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়েছে, এবং ২০০২ সনে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক আইনের এমেরিটাস অধ্যাপক জে. এ. জলোইকের এক প্রবন্ধে কমন ল’ ও সিভিল ল’ ব্যবস্থার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অনুসন্ধানমূলক পদ্ধতির অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে কিভাবে দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি লাভবান হতে পারে, তা চমৎকারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

Tags

- Advertisement -