পাঁচ তারকা হোটেল থেকে অর্থপাচার : কৃষক লীগ নেতার ঋণ কেলেঙ্কারি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মহলে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনা ক্রমশ বাড়ছে। এসব কেলেঙ্কারির মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা আলম আহমেদের ঋণ কেলেঙ্কারি। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ‘হলিডে ইন’ নামে পাঁচ তারকা হোটেল। হোটেলটির মালিক আলম আহমেদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় এবং ঋণ খেলাপি হওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন ঋণ আদায়ে বিপাকে পড়েছে।

‘হলিডে ইন’ নামের এ হোটেলটির প্রকৃত মালিকানা হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অধীনে। এই হোটেলের নামেই আলম আহমেদ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া তার মালিকানাধীন মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে রয়েছে ৪৮৩ কোটি টাকা এবং ব্যক্তিগতভাবে আরও ১৫৪ কোটি টাকার ঋণ। এসব ঋণ তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, অগ্রণী, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামীসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে নিয়েছেন।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আলম আহমেদ ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। ঋণ নেওয়ার পর কোনো কিস্তি পরিশোধ না করায় ঋণ আদায় এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

হলিডে ইন হোটেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হোটেলের ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। অতিথির সংখ্যা প্রায় শূন্য, কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, “রুমগুলো প্রায় খালি, রেস্টুরেন্টেও অতিথির সংখ্যা খুবই কম। কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতনও দেয়া হচ্ছে না।” যদিও হোটেলের মার্কেটিং কমিউনিকেশন ম্যানেজার মানফুজা মাসুদ চৌধুরী দাবি করেছেন যে, দেশের পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর অবস্থা বর্তমানে ভালো না হলেও, তাদের আনুষঙ্গিক সেবা চালু রয়েছে এবং কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন।

অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির এই ঘটনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে আলম আহমেদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগের মাধ্যমে। একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের একটি বড় অংশ তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। যুক্তরাজ্য ও থাইল্যান্ডে বাড়ি, গাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মরিয়ম গ্রুপের ওয়েবসাইটে তার বিদেশি ব্যবসার ঠিকানা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তার অফিস ‘মরিয়ম বেঙ্গল’, এবং ব্যাংককে ‘সার্কেল কনডো’ নামে আরেকটি অফিস রয়েছে।

এই কেলেঙ্কারি তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে আলম আহমেদ যে জালিয়াতি করে ঋণ নিয়েছেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তদন্ত চলছে। ২০২২ সালে দুদক এ বিষয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তাকে সাক্ষাৎ দিতে বলা হয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন ব্যাংকটির সাবেক এমডি ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

জনতা ব্যাংকের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে আলম আহমেদের হোটেলকে নতুন ঋণ দেয়া হয়েছে। জনতা ব্যাংকের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের প্রতিবেদনেও এই ঋণ অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে হাবিব হোটেলসহ অন্যান্য ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা, যা এখন পুরোটাই খেলাপি।

হাবিব হোটেলের ঋণ গ্রহণ ও বিতরণের প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। জনতা ব্যাংকের শাখার কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকেরা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঋণটি পুনঃতফসিল করার পরও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো অর্থ আদায় করতে পারেনি, কারণ ঋণের অর্থ মূলত অন্য খাতে ব্যয় করা হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণ বিতরণ ও এর ব্যবস্থাপনার যে সংকট ক্রমাগত প্রকট হচ্ছে, আলম আহমেদের ঘটনা তার একটি বড় উদাহরণ। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও জালিয়াতি মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাত এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। এই ধরনের কেলেঙ্কারিগুলো না শুধরালে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা আরও বড় ধাক্কা খাবে।

Tags

- Advertisement -