সশস্ত্র বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের

সশস্ত্র বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং বাহিনীর অভ্যন্তরে সামরিক আইন সংস্কারে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। তাঁদের মতে, সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং বাহিনীর স্বাভাবিক পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে সামরিক আইনকে পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।

শনিবার রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএস এলাকায় অবস্থিত রাওয়া ক্লাবের ঈগল হলে আয়োজিত “বৈষম্যমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী—বাংলাদেশ ২.০: বিনির্মাণ প্রয়োজনীয় রূপরেখা” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ দাবি জানান। সভায় সভাপতিত্ব করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কমান্ডার (অব.) নেছার আহমেদ জুলিয়াস।

নেছার আহমেদ তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, সশস্ত্র বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে সামরিক আইন ও নিয়মের অপব্যবহার করে বাহিনীর মেধাবী কর্মকর্তাদের অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে রাখতে হলে আইনের সংস্কার প্রয়োজন।

বক্তারা আরও উল্লেখ করেন যে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের পুনর্বহাল করা উচিত। যাঁদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাঁদের জন্য আর্থিক সহায়তার দাবিও জানানো হয়। এই দাবিগুলোর উদ্দেশ্য হল সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে অবিচার দূর করা এবং সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা।

সভায় বক্তারা সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তোলেন। তাঁদের দাবি, ডিজিএফআই-এর কিছু কর্মকর্তারা অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিলেন। বিশেষ করে, গুম, খুন, ও নির্যাতনের মতো ঘটনা নিয়ে বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা ডিজিএফআই-এর পাশাপাশি এনটিএমসি দ্বারা বেআইনিভাবে ফোনে আড়িপাতা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করেন এবং এসব অপরাধে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করেন।

বক্তারা সামরিক বাহিনীর ভূমিকা এবং বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার কথাও উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, বিশেষ করে গত ১৫ বছরে গুম, খুন এবং ‘আয়নাঘরের’ মতো ঘটনায় ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, “খুনি-ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এই অব্যবস্থাপনার প্রতিক্রিয়ায় ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।”

সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করে জানান, “২০১১ সালে আমাকে গুম করা হয়। ৪৩ দিন আমি বন্দি ছিলাম, হাত-পা এবং চোখ বাঁধা অবস্থায়। আমার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা ছিল মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।” তিনি জানান, তাঁর এই দুর্ভোগের কারণ ছিল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, যিনি ‘র’ এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন বলে অভিযোগ করেন।

আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, লে. কর্নেল (অব.) শাহির বীর প্রতীক, কমান্ডার (অব.) মোহাম্মদ শাহরিয়ার আকন্দ, মেজর (অব.) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, ক্যাপ্টেন (অব.) হেফাজ উদ্দিন এবং লেফটেন্যান্ট (অব.) সাইফুল্লাহ খান। বক্তারা সামরিক বাহিনীর ভবিষ্যৎ গঠন এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেন। তাঁরা আরও বলেন, সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে রাখাই বাহিনীর উন্নতি এবং দেশের স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি।

সভায় বক্তৃতাকারী সকলেই একমত যে, সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে এবং তাদের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে সামরিক আইন সংস্কার অপরিহার্য। তাঁরা সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে বলেন, সামরিক বাহিনীকে জনগণের বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা উচিত, কোনো রাজনৈতিক দলের বাহিনী নয়।

Tags

- Advertisement -