যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার জটিল জলবায়ু সংকটের ছায়া

গাজার পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান ইসরায়েলি হামলার ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখনো স্পষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও, গাজার পরিস্থিতি এখনো আন্তর্জাতিক আড়ালে রয়ে গেছে। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সামরিক দূষণ এবং এর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতির বিশ্লেষণ আজ অত্যাবশ্যক।

গত বছরের ৭ অক্টোবর, সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে হামলা করে, যার পর থেকে তেল আবিব গাজার ওপর সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। এ ফলে গাজার প্রায় সব অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায় এবং প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ইসরায়েলি হামলার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি সামরিক তৎপরতা থেকে উৎপন্ন কার্বন নিঃসরণ পরিবেশগত সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে, যা শুধুমাত্র গাজার জন্য নয়, বরং বিশ্বের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জুনে প্রকাশিত ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, গাজার যুদ্ধের পরিবেশগত প্রভাব অভূতপূর্ব। এখানে সামরিক অস্ত্রের বড় আকারের ব্যবহার জলবায়ুর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতি করেছে, যা অন্যান্য সংঘাতের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন পর্যায়ে সামরিক বাহিনী বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে। সামরিক বাহিনীগুলো বার্ষিক বৈশ্বিক নিঃসরণের ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বেশির জন্য দায়ী, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

কনফ্লিক্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অবজারভেটরির ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, সামরিক বাহিনীগুলোর কার্বন ফুটপ্রিন্ট দেশের হিসেবে বিবেচনা করলে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম। তবে সব তথ্য প্রকাশ না হওয়ায় এর প্রকৃত পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুসারে, এ শতকে প্রাক-শিল্পযুগ পরবর্তী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সফলভাবে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকল থেকে সামরিক নিঃসরণ বাদ দিয়েছে, এবং প্যারিস চুক্তিও এ বিষয়ে তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করেনি।

ফিলিস্তিনি পরিবেশ কর্মকর্তাদের মতে, চলমান পরিস্থিতিতে জলবায়ু সংকটের সব ধরনের উদ্বেগের কারণ উপস্থিত। ফিলিস্তিনের এনভায়রনমেন্টাল কোয়ালিটি অথরিটির (ইকিউএ) জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিভাগের প্রধান হাদিল ইখমাইসের মন্তব্য, ইসরায়েলের হামলা শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ বা সামরিক পদক্ষেপ নয়, বরং এর প্রভাব অনেক বড়। তিনি উল্লেখ করেন, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০২১ সালে প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ টন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করেছে, যা সুইডেনের সামগ্রিক অর্থনীতির বার্ষিক নিঃসরণের সমান।

গাজার যুদ্ধকালীন কার্যক্রমের কারণে গত জুনে লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি পরিচালিত জরিপ অনুসারে, গাজার সংঘাতের প্রথম ১২০ দিনের কার্বন নিঃসরণ ২৬টি দেশ ও অঞ্চলের বার্ষিক নিঃসরণকে ছাড়িয়ে গেছে। এ সংঘাতের ফলে গাজার অবকাঠামোর নিঃসরণ ৩৬টি দেশ ও অঞ্চলের চেয়ে বেশি হয়েছে। গাজার ধ্বংসাবশেষের পরিমাণ এতটাই বিপুল যে, গত মে পর্যন্ত আনুমানিক ৩ কোটি ৯০ লাখ টনের বেশি ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে, যা ২০০৮ সাল থেকে গাজার সব সংঘাতের মোট ধ্বংসাবশেষের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি।

গাজার পুনর্গঠনে সামরিক অভিযানগুলোর ফলস্বরূপ যে ধ্বংসাবশেষ তৈরি হচ্ছে, তা পরিবেশে বিপজ্জনক অ্যাসবেস্টস, রাসায়নিক বা জৈবিক বর্জ্য ছড়িয়ে দিতে পারে। এইসব বর্জ্য পরিবেশ দূষণে অবদান রাখছে। গাজার পানির ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় ঘটেছে। গাজায় অপরিশোধিত বর্জ্য এবং পয়ঃনিষ্কাশন সড়ক ও ভূমধ্যসাগরে উপচে পড়ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় গাজার পরিবেশগত সমস্যা বেশি জটিল। পানির অভাব, মরুকরণ, বায়ু দূষণ এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা সহ অনেক সমস্যা এখানে বিদ্যমান। হাদিল ইখমাইসের মতে, ফিলিস্তিনের মতো দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য বেশি মূল্য দিচ্ছে, যদিও তাদের বৈশ্বিক নিঃসরণে অবদান অত্যন্ত কম।

ফিলিস্তিনের জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান নিয়ে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু চলমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে। গাজার পরিস্থিতি আজ জলবায়ু পরিবর্তন ও রাজনৈতিক ইস্যুর একটি দুষ্ট চক্রে পরিণত হয়েছে। মৌলিক চাহিদা, যেমন খাদ্য ও বাসস্থানের বিপরীতে জলবায়ু লক্ষ্য নির্ধারণ অতিবিলাসিতা মনে হতে পারে।

এভাবে গাজার বর্তমান পরিস্থিতি শুধুমাত্র মানবিক সংকট নয়, বরং একটি গভীর পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত গাজার জলবায়ু সংকট ও এর সামাজিক প্রভাবগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

Tags

- Advertisement -