সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি  ভারতের দখলে !

সুন্দরবন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, তার প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য সুপরিচিত। এই অঞ্চলের এক অনন্য উপহার হলো সুন্দরবনের মধু, যা তার স্বাদ ও ঔষধি গুণাগুণের জন্য বিখ্যাত। তবে সম্প্রতি প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এই মধু ভারতের ভৌগোলিক নির্দেশক (জি আই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা।

সুন্দরবনের মধু তার স্বতন্ত্র স্বাদের জন্য প্রসিদ্ধ। এই মধু প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ফুল থেকে সংগৃহীত হয়, যার ফলে এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ঔষধি গুণাগুণ। মধুর স্বাদ ও সুগন্ধ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এটি শুধুমাত্র সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ পরিবেশে পাওয়া যায়। এ থেকেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতির গুরুত্ব সম্পর্কে অনুধাবন করা যায় ।

ভৌগোলিক নির্দেশক (জি আই) একটি আইনি স্বীকৃতি যা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট হয়। কোন পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পণ্যটির মান, সুনাম এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যকে স্বীকৃতি দেয় যা পণ্যটির সুরক্ষা ও বিপণনে সাহায্য করে। সুন্দরবনের মধু যদি বাংলাদেশ থেকে জিআই স্বীকৃতি পেতো, তবে তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ মর্যাদা পেতো এবং এটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন সম্ভব হতো।

সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন।১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের মোট আয়তনের বেশিরভাগ অঞ্চলই(৬৬%) রয়েছে বাংলাদেশে এবং অপেক্ষাকৃত কম অঞ্চল (৩৪%) রয়েছে ভারতের মধ্যে। এছাড়া সুন্দরবনের মধু আহরণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে দ্বিগুণ এগিয়ে রয়েছে।অথচ অপেক্ষাকৃত কম অঞ্চল অধিকারে থাকা সত্ত্বেও ভারত সক্রিয়তার সাথে এবং সুনিঁখুত ভাবে সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি নিজেরা অর্জন করেছে।  ভারত কীভাবে আগে এ পণ্যের জিআই নিবন্ধন করতে পারল, তা নিয়ে বিস্মিত অনেকেই । অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের মধুকে তারা তাদের নিজেদের একান্ত ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে বিবেচনার ও স্বীকৃতির ইঙ্গিত দিল। একই সাথে বাংলাদেশের এক্ষেত্রে পরিচয়গত ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ফুটে উঠলো।

বাংলাদেশে জিআই স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এবং সঠিক পদক্ষেপের অভাবের কারণে সুন্দরবনের মধু ভারতের জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়েছে, কারণ এটির মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য মধুর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং বাজার হারিয়ে যেতে পারে।

ঘটনা সূত্রপাত ২০১৭ সালে, বাগেরহাট জেলা প্রশাসক প্রথম সুন্দরবনের মধুকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আবেদন করলে পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে সাত বছর পর ২০২৪ সালের ৩০ শে জুন বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয় বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে ২০২১ সালে ভারত সুন্দরবনের মধুর জি আই সত্ত্ব পাবার হিসেবে আবেদন করে, ফলস্বরূপ জুলাই মাসে বিশ্ব মেধা সম্পদ সংস্থা(ডব্লিউ পি আই ও) পণ্যটিকে তাদের জি আই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে।

বাংলাদেশের ভারতের প্রায় চার বছর আগে আবেদন করেও স্বীকৃতি পাবার ক্ষেত্রে এই বিলম্বের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের অজুহাত -প্রয়োজনীয় কাগজপত্র,সার্টিফিকেট ইস্যু করার জন্য প্রয়োজনীয় সব নথি পেতে দেরি হওয়ায় এমনটা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে গুরুত্বের অভাব এবং সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে এই ব্যর্থতা ঘটেছে। এটির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এর সম্ভাব্যতা সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট পরিমাণে কার্যকর হয়নি।

কোনো পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ বা জিআই সনদ পেতে প্রথমে আবেদন করা হয়, পরবর্তীতে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সে ব্যাপারে অফিশিয়াল গেজেট প্রকাশের পর কোন আপত্তি না উঠলে বা আপত্তি মীমাংসিত হলে পণ্যটিকে জিআই সার্টিফিকেট দেয়া হয়। বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যগুলোর স্বীকৃতি ও ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের (MOI)। এক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (DPDT) দেশের জিআই পণ্যগুলোর নিবন্ধন ও সুরক্ষার কাজ করে থাকে। ২০১৫ সাল থেকে, DPDT বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার (WIPO) মান অনুযায়ী সক্রিয়ভাবে জিআই পণ্য নিবন্ধন করে আসছে। মূলত তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই বাংলাদেশ এই স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছে ।

অপরদিকে , ভারত সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা করেছে। প্রশাসনিক পর্যায়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ, সময়মতো আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং মধুর গুণাগুণের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ভারত সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারতের এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, সঠিক নীতি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ সুরক্ষা ও ব্যবহার সম্ভব।

সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি ভারতের দখলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মধু উৎপাদক এবং ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে একটি বড় সুযোগ হারিয়েছে। তাছাড়া, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা এবং এর সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব স্পষ্ট হয়েছে।

এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে আরও কার্যকর নীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এর সম্ভাব্যতার সঠিক মূল্যায়ন এবং সংরক্ষণ করার জন্য একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা জরুরি। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সময়মতো আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাংলাদেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পণ্য সম্পর্কে সচেতনতা ও জ্ঞান আহরণ করা প্রয়োজন, যাতে তা কেবলমাত্র বাংলাদেশেরই নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতিসংক্রান্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাকি ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যগুলো যাতে শীঘ্রই যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশের জিআই হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের নিজস্ব একত্রিশটি জিআই পণ্য রয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে জামদানি শাড়ি, ইলিশ মাছ, সিলেটি চা, রাজশাহী সিল্ক, ফজলি আম, বগুড়ার দই, সাতক্ষীরার চিংড়ি ইত্যাদি। এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজনগুলোর মধ্যে রয়েছে জামালপুরের নকশী কাঁথা, রাজশাহীর মিষ্টি পান, এবং যশোরের খেজুরের গুড়। আবার এরকম তিনটি পণ্য রয়েছে যা দ্বৈত ভাবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত, এগুলো হল জামদানি শাড়ি, নকশি কাঁথা ও ফজলি আম। এই উদাহরণগুলো উভয় দেশের সংস্কৃতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর নিজস্ব সংস্করণকে একইসাথে প্রদর্শন করে, যা দ্বৈতভাবে দুই দেশেরই পণ্য হিসেবে স্বকীয়ভাবে তাদের অনন্য গুণাবলী এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। এই দ্বৈত স্বীকৃতি সমানভাবে দুই দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে তুলে ধরে এবং প্রতিটি অঞ্চলের অবদানকে আলাদাভাবে বহন করে ।

এই বিষয়টি থেকে স্পষ্ট যে,বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জিআই বিরোধ নিষ্পত্তি পরস্পর দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই করা সম্ভব, যা একই সাথে কূটনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রচেষ্টার গুরুত্বকে তুলে ধরে। তাছাড়াও, উভয় দেশই ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন, গবেষণা এবং আইনি কাঠামোর অপরিহার্যতা সম্পর্কের সচেতন। ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি অবস্থিত হবার কারণে দুটি দেশের পারস্পরিক সংস্কৃতি, উপাদান ও আচার সংশ্লিষ্ট কিছু মিল লক্ষ্য করা যায় ।মূলত এ থেকেই দুই দেশের মধ্যে সুন্দরবনের মধুর জিআই সনদ প্রাপ্তি সংক্রান্ত সমস্যার সূত্রপাত। যেখানে অধিক কূটনৈতিক তৎপরতা ও সমন্বয় দেখিয়ে সফলতা পেয়েছে ভারত । তবে এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কার্যকর নীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাব্যতাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। অতএব ভবিষ্যতে বিরোধ এড়াতে এবং ন্যায্য স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে, বাংলাদেশের পক্ষে তার জিআই নিবন্ধন প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা, জিআই ট্যাগের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সক্রিয় কূটনীতিতে জড়িত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে এবং বিশ্ববাজারে তার অনন্য পণ্যগুলি প্রচার করতে সহায়তা করবে। কেননা জিআই সনদ কেবল একটি স্বীকৃতি নয় বরং তা পণ্যকে সেই দেশের বা অঞ্চলের একান্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পণ্য হিসেবে পরিচিত করে যা পণ্যটির বিপণনে ও আন্তর্জাতিক বাজার বাড়াতে সাহায্য করে এবং এর মাধ্যমে সে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও হতে পারে। সুতরাং সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমেয়।

Tags

- Advertisement -