আফ্রিকায় রাশিয়ার উত্থান ও ফ্রান্সের পতন

আফ্রিকা তার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৌশলগত অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ফ্রান্স, পূর্বের ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে বহু বছর ধরে আফ্রিকার বহু দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সামরিক প্রভাব বজায় রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়েছে। রাশিয়া নিজেকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে, বিশেষ করে আফ্রিকায়। এই অঞ্চলে তাই স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্সের প্রভাব কমতে শুরু করেছে এবং রাশিয়া আফ্রিকার নতুন একটি প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ফ্রান্স বহু বছর ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সাথে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে, বিশেষ করে সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোর সাথে। তবে এই সম্পর্ক এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ফ্রান্সের প্রতি আফ্রিকার সাধারণ জনগণের বিরূপ মনোভাব বাড়ছে, যা রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। মালি এবং বুরকিনা ফাসোর সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থানগুলোর পর ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীকে এসব দেশ থেকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এসব অঞ্চলে জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ, ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতি আফ্রিকার ফ্রান্সের জনপ্রিয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

ফ্রান্সের রাজনৈতিক প্রভাবের পতন আফ্রিকায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বহু দশক ধরে ফ্রান্স আফ্রিকার রাজনীতিতে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্যদিকে মালিতে ফ্রান্সের সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটি এখন রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকও ফ্রান্সের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষেবা গ্রহণ করছে। ফ্রান্সের এই পতন শুধু সামরিক নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্তরেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফ্রান্সের সাথে যুক্ত বহু ব্যবসা এবং চুক্তি রাশিয়ার প্রভাবের কারণে সংকুচিত হচ্ছে।

রাশিয়ার আফ্রিকায় কৌশলগত প্রবেশ করার পরিকল্পনা সুসংগঠিত এবং দীর্ঘমেয়াদী। সামরিক চুক্তি, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং রাজনীতির সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে রাশিয়া আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে।

উত্তরে লিবিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ওয়াগনার গ্রুপের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অঞ্চলের কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, রাশিয়া সেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে সহায়তা করছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরাই সরাসরি এসব কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমানা সেখানেই শেষ না।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যে মস্কো “আফ্রিকাতে পশ্চিমা-বিরোধী রাষ্ট্রগুলোর একটি কনফেডারেশন” তৈরি করতে চাইছে, এবং নিরাপত্তার ফাঁক-ফোকরের ভেতর দিয়ে স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেসব দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। এর মাধ্যমে রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোর সরকারকে তাদের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করছে, যা ঐ অঞ্চলে ফ্রান্সের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবকে কমিয়ে দিচ্ছে।

ফ্রান্সের আফ্রিকায় আধিপত্য ঐতিহাসিকভাবেই ঔপনিবেশিক শাসনের আমল থেকে চলে আসছে।

স্বাধীনতার পর থেকে প্রাক্তন ফরাসি-ভাষী উপনিবেশ (যাকে ফ্র্যাঙ্কোফোন আফ্রিকা বলা হয়)উপনিবেশটির সাথে ফ্রান্স সম্পর্ক এবং প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিল। ফ্রান্সের সাথে তাদের যোগাযোগ ঐতিহ্যগতভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং মানব উন্নয়ন সংস্থার বিষয়গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পাশাপাশি একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক উপস্থিতিও ফ্রান্স বজায় রেখেছিল।২০১২ সালের শেষের দিক থেকে এই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।

সেবছর ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো উত্তর মালির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং বামাকোর সরকার এই ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য জাতিসংঘের কাছে সাহায্যের অনুরোধ করে। ফ্রান্স এই আহ্বানে সাড়া দেয় এবং জাতিসংঘের সমর্থন নিয়ে ফ্রান্স ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে “অপারেশন সার্ভাল” শুরু করে। কিন্তু সামরিক ব্যর্থতা, লড়াইয়ের কঠোরতা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোর ধ্বংস জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালি, বুরকিনা ফাসো, এবং নাইজারের মতো দেশে ফরাসি বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বদলে দিয়েছে। এই অঞ্চলে সামরিক অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ফ্রান্সের প্রতি অনাস্থার প্রতিফলন এবং রাশিয়ার জন্য একটি সুযোগের সৃষ্টি করেছে।

রাশিয়ার আফ্রিকায় প্রবেশ শুধুমাত্র সামরিকভাবে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। ২০১৯ সালে সোচিতে অনুষ্ঠিত “রাশিয়া-আফ্রিকা সামিট” রাশিয়ার এই অঞ্চলে তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা স্পষ্ট করেছে। রাশিয়া আফ্রিকায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে তেল, গ্যাস, এবং খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার লাভের চেষ্টা করছে। এর সাথে সাথে, রাশিয়া আফ্রিকার রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যারা পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা ও নিয়ন্ত্রণের শিকার। রাশিয়ার মাধ্যমে এই নেতারা একটি বিকল্প শক্তি পাচ্ছেন, যা তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করছে।

বর্তমানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেলের বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির ২০১৭ সালে রাশিয়ার সাথে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল লোহিত সাগরে পোর্ট সুদানে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ, পাশাপাশি সুরা এম ইনভেস্ট কোম্পানির সাথে সোনার খনির ব্যবসা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এই কোম্পানির পেছনে রয়েছে ওয়াগনার গ্রুপ।

রাশিয়ার সাফল্যের মূল কারণ তার কৌশলগত অবস্থান। রাশিয়া ফ্রান্সের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে প্রবেশ করছে ।যার ফলে ফ্রান্স তার প্রভাব হারাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকায় রাশিয়ার উপস্থিতি ফ্রান্সের পতনের দিকে ধাবিত করছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ, এবং রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে রাশিয়া তার অবস্থান মজবুত করছে। এর সাথে সাথে রাশিয়া ফ্রান্সের মতো ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নিষ্ঠুর সাক্ষ্য বহন করছে না, যা আফ্রিকান নেতাদের কাছে তাদেরকে ফ্রান্সের থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে রাখছে। রাশিয়া আফ্রিকায় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন দেখিয়ে নেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে, যা তাদেরকে সে অঞ্চলে পশ্চিমা জোটদের থেকে বেশি সফলতা দিতে সাহায্য করছে।

রাশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্কও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাশিয়া আফ্রিকার খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে বিনিয়োগ করছে, যা আফ্রিকার অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তেল, গ্যাস, এবং অন্যান্য সম্পদের জন্য চুক্তি রাশিয়াকে আফ্রিকান অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত করেছে। রাশিয়ার বিনিয়োগের মাধ্যমে আফ্রিকার অনেক দেশ তাদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ এবং সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে, যা ফ্রান্সের দীর্ঘমেয়াদী আধিপত্যকে প্রতিস্থাপন করছে।

আফ্রিকায় রাশিয়ার সাম্প্রতিক উত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে। রাশিয়া, বিশেষ করে ২০১০ সালের পর থেকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলোর সাথে তার কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক আরও জোরদার করছে। এই উত্থানের মূল লক্ষ্য পশ্চিমা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করা এবং আফ্রিকায় তার নিজস্ব স্বার্থকে বিস্তৃত করা। সামরিক সহযোগিতা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও রাজনৈতিক সমর্থন—এই তিনটি বিষয়ে রাশিয়া তার উপস্থিতি বাড়াচ্ছে-সামরিক চুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ, রাজনৈতিক সমর্থন।

২০২৩ সালের রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলন, যা সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত হয়, এই শীর্ষ সম্মেলনে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের নেতারা রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে চুক্তি করেন। তাছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাশিয়া বর্তমানে আফ্রিকার প্রায় ২০টির বেশি দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং তার প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো যেমন ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, এবং যুক্তরাজ্য এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

পরিশেষে সামরিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে রাশিয়া আফ্রিকায় তার অবস্থান শক্তিশালী করছে। অন্যদিকে, ফ্রান্স তার দীর্ঘমেয়াদী আধিপত্য হারাতে শুরু করেছে। রাশিয়ার এই নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভাব ভবিষ্যতের আফ্রিকান রাজনীতি ও অর্থনীতির ভারসাম্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আফ্রিকা এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে ,যেখানে রাশিয়া তার প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে এবং সেখানে ফ্রান্স তার ক্ষমতা হারাচ্ছে। আর রাশিয়া কি ফ্রান্সকে হটিয়ে আফ্রিকার সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী বহি:দেশ হিসেবে আবিভূত হবে কিনা তার সময়ই বলে দেবে।

Tags

- Advertisement -