ডলার সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংককের সক্রিয় পদক্ষেপ

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেরই অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের ব্যতিক্রম নয়। আর এই চলমান সংকটের একটি বড় কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় ডলার সংকটকে। ২০২০ সালের করোনা মহামারী পর থেকে মূলত সমস্যা সৃষ্টি হলেও ২০২২ সালের রাশিয়ার ইউক্রেন ভূখণ্ডে হামলার পর থেকে সংকট উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা দেয়। বিশেষত ২০২৩ সালের পর এ সংকট যেন বিদায়ের নামই নিচ্ছেনা। অর্থনৈতিক অন্যতম সূচক হল রিজার্ভ। ২০২৩ সালের মধ্যভাগে দেশের রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে নিচে নেমে আসে। যা গত কয়েক বছরে তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে রিজার্ভ ৩৬.৩ বিলিয়ন ডলার, পরের অর্থবছরের ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২২- ২৩ অর্থ বছরে ৩১ বিলিয়ন ডলারে ও সদ্য বিদায়ী বছরে তা ছিল ২৬.৮৮ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বিশ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এক্ষেত্রে যতই ডলার সংকট বেড়ে চলছে ততই বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাসীনতা চোখে পড়ছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক হচ্ছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং কার্যতঃ ব্যাংক সমূহের ব্যাংক। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল সংরক্ষণ করে থাকে। বিশ্বের অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল কাজগুলো হলো-মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ পরিচালনা, ব্যাংকিং খাতায় নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি, সরকারি ঋণ পরিচালনা, পেমেন্ট সিস্টেম পরিচালনা, মুদ্রা ইস্যু ও সরবরাহ করা ইত্যাদি। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে এ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তাই সঙ্গত কারণেই এ চলমান সংকটের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করা যায়। কারণ ডলার সংকট মোকাবেলায় তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ – রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নির্দেশনা, বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও প্রাপ্যতা বৃদ্ধি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স প্রণোদনা, নিয়ন্ত্রিত আমদানি এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকটকালীন সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করে ডলার সংকট মোকাবেলা ভূমিকা রাখে। বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বা নীতি প্রণয়ন করে। বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলিকে ডলার সংকট মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করে। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি করে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করতে প্রণাদনা প্রদান করে থাকে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডলার ব্যয়ের পরিমাণ কমানোর ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে।

ডলার সংকটের কারণ সংক্ষেপে উল্লেখ করলে যে কারণগুলো উঠে আসে তা হল পণ্যের আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে যাওয়া, মুদ্রার মানের নিম্নগতির কারণে রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়া, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ফরেন কারেন্সির উপর চাপ বাড়া এমনকি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া দেশের স্থবিরতা ও অস্থিতিশীলতার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক অনিশ্চিয়তা বেড়েছে। এ সমস্ত কারণ একত্রে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে চাপের মুখে ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা হোক বা যে কারণেই হোক ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেমন আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ডলারের অভাবে আমদানিকারকদের উচ্চ হাড়ে ডলার কিনতে হচ্ছে যা আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে আমদানি করা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছে। এছাড়াও এ সংকটের ফলে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পেয়ে দেশীয় বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, কারণ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে জ্বালানির তেল পর্যন্ত সবকিছুর দাম বাড়ছে। রপ্তানি খাত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডলারের অপ্রতুলতার কারণে রপ্তানিকারকদের আমদানি করা কাঁচামাল ও উপকরণ প্রয়োগ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। যা রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সমস্যা হচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগের উপর ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কেননা বিনিয়োগকারীরা ডলারের অপ্রতুলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকছেন। কেননা স্বভাবতই বিনিয়োগকারীরা লাভের ভবিষ্যৎ না দেখলে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী কখনোই হবেন না ।আবার, মুদ্রা সংকটের কারণে দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সমস্যা হচ্ছে। দেশের মানুষের উপর এক বড় বোঝা তৈরি করছে এই ঋণের অংক।ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। বর্তমানে জিডিপি অনুপাতে বিদেশি ঋণের হার প্রায় ২২ শতাংশ। গত ৮ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩৫ শতাংশ। গত জুনের হিসাবে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়ে ৫৭৪ ডলার (প্রায় ৬৩ হাজার টাকা), যা আট বছর আগে ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ পরিস্থিতি মোটেও সুখবর নয়। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স প্রেরণে কিছুটা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। প্রবাসী বাঙালিরা ডলার পেতে দেরি হওয়ায় হুন্ডি বা অন্য কোন উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর চেষ্টা করছেন। যা দেশকে তার পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটছে। তাতে তাদের আর্থিক কষ্ট বাড়ছে। আমদানির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও উপকরণ সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে, ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়ে সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি বিদেশ থেকে শিক্ষা উপকরণ ও চিকিৎসা সামগ্রী আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই শিক্ষার মান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।

এ ডলার সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, দেশীয় উৎপাদন খাতের দুর্বলতা এবং রেমিটেন্স প্রবাহে অব্যাহত চাপের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য সুসংহত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ এর মাধ্যমে ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমানো, রপ্তানির নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য আরো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, এবং রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য প্রণোদনা প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, পূর্বে বিগত সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত বলে প্রমাণিত হয়নি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ডলার সংকট সমাধানে সরকারের আরো দৃঢ় এবং সুসংহত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বরং দীর্ঘমেয়াদী এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন এবং আমদানিকারকেরা ও বারবার বলছেন, বর্তমান ডলার সংকট তাদের ব্যবসায়ের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এই সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার স্বার্থে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে:
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা: ডলার রিজার্ভ সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং এর ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন।
নীতি সংস্কার: আমদানি- রপ্তানি নীতিতে সংস্কার আনা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা। নীতি সংস্কারের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
বৈদেশিক ঋণ: বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে ডলার রিজার্ভ বাড়ানো এবং সংকট মোকাবেলার প্রচেষ্টা।
ব্যবস্থা গ্রহণ: কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং রিজার্ভের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত করা। এ সচেতনতা বৃদ্ধি দেশে অর্থনীতি রাখতে সহায়ক হবে।
বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন: বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়ানো যেতে
পারে।
দুর্নীতি রোধ: সকল কর্মকর্তা(উর্ধতন পদধারী সহ) ও কর্মচারীদের মধ্যে কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে দূরে রাখতে হবে -সর্বোপরি দেশের স্বার্থেই তাদের কাজ করতে হবে।

বিকল্প ব্যবস্থা: ডলার সংকট মোকাবেলায় বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। এক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রার বাণিজ্য, রপ্তানি বৈচিত্রকরণ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিয়োগ চুক্তি, সঞ্চয়বৃদ্ধি, স্থানীয়উৎপাদন বৃদ্ধি ফলে ডলার ব্যয়ের চাপ কমবে। এই বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ডলার সংকটের চাপ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা যাবে।

পরিশেষে বলা যায়, ডলার সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি। দেশের মানুষ সংকটের মুখ দেখার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে সুপরিকল্পিত ও কার্যকর ভাবে ডলার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য ডলার সংকটকে দ্রুত সমাধান করতে হবে। এর সমাধানে দীর্ঘ মেয়াদের প্রয়োজন হলেও সত্যিকারের কার্যকর কৌশল গ্রহণ করলে অবশ্যই এর সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতির মঙ্গল আনয়নের স্বার্থে এবং সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা মান উন্নত করতে বাংলাদেশের ব্যাংকের কার্যকর পদক্ষেপ অতি জরুরী।

Tags

- Advertisement -